মৃত্যুর পরে তাঁরই দান করা চোখে অন্য কেউ পৃথিবীকে দেখবে, নতুন চক্ষুষ্মানের দৃষ্টিতে বেঁচে থাকবেন দাতা— এই আশা নিয়েই চক্ষু দানের অঙ্গীকার করেন মানুষ। কিন্তু যে সব চোখ সংগ্রহ করা হয় , তার কত শতাংশই বা অন্ধজনে আলো দেয়?
কলকাতার রিজিওনাল ইনিস্টটিউট অফ অপথ্যালমোলজি (আরআইও)-র ২০০৮ সালের হিসেব, ওই বছর সংগৃহীত ৭৫০টি কর্নিয়ার মধ্যে দৃষ্টিহীনদের চোখে বসানো গিয়েছে মাত্র ২৪০টি! বাকিগুলি ব্যবহার ব্যবহার করা হয়েছে পড়াশোনা ও গবেষণার কাজে। এর ফলে চক্ষুদানের মূল উদ্দেশ্যটাই যে ব্যাহত হচ্ছে, ভারপ্রাপ্ত চিকৎসকেরা তা অস্বীকার করেননি।
দৃষ্টিহীনদের চক্ষুষ্মান করার প্রক্রিয়ার এই হাল কেন?
আরআইও-র চিকিৎসকেরা বলেন, “গত বছর সংগৃহীত ৭৫০টি চোখের মধ্যে ৩৫০ থেকে ৪০০টিকে আসল উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যেত। দৃষ্টি ফিরে পেতেন সমসংখ্যক দৃষ্টিহীন মানুষ। কিন্তু রাজ্যের দূরদূরান্ত থেকে চোখ সংগ্রহ করে আনতে আনতেই তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে গবেষণার কাজ ছাড়া সেগুলির আর কোনও ব্যবহারযোগ্যতা থাকছে না।”
আরআইও-র অধিকর্তা গৌতম ভাদুড়ি বলেন, “১০০টি চোখ সংগ্রহ করলে আমরা তার মধ্যে মাত্র ৪০টি গ্রাফটিং করতে পারি। ধরা যাক, বালুরঘাট বা বাঁকুড়া থেকে কোনও চোখ সংগ্রহ করা হল। সেখান থেকে কলকাতায় আনতে আনতেই তো সেই চোখ আর গ্রাফটিংয়ের উপযুক্ত থাকছে না। জেলা স্তরে চোখ সংগ্রহ ও গ্রাফটিংয়ের ব্যবস্থা গেড় না ওঠা পর্যন্ত পরিস্থিতি শোধরাবে না।” তিনি জানান, শিলিগুড়িতে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের দু’টি হাসপাতালে গ্রাফটিংয়ের ব্যবস্থা হয়েছিল। লাইসেন্সও দেওয়া হয় তাদের। কিন্তু তারা একেবারেই ভাল কাজ করছে না বলে গৌতমবাবুর অভিযোগ। তিনি বলেন, “এর ফলে উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত এলাকা থেকেও চোখ আসছে আমাদের এখানে। ১২-১৪ ঘণ্টার রাস্তা আসার পরে সেই চোখ ভাল থাকতে পারে কি?”
কলকাতার সরকারি হাসপাতালগুলি থেকে গত বছর তারা মোট ১০৫টি কর্নিয়া সংগ্রহ করেছে বলে দাবি করেছে এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। ওই সংগঠনের প্রধান ভাস্কর সিংহের দাবি, “আমরা যে ক’টি কর্নিয়া সংগ্রহ করি, তার সবই কর্মক্ষম। পরে পরীক্ষা করে দেখা যায় তার মধ্যেও কিছু কর্নিয়ার গুণগত মান অন্যের চোখে প্রতিস্থাপিত করা যায় না। সেটা মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু কর্নিয়া সংরক্ষণের যথাযথ পরিকাঠামো না থাকায় যে হারে কর্নিয়া নষ্ট হচ্ছে, তাতে মানুষকে আমরা কী ভাবে যে আর চক্ষুদানে উৎসাহিত করতে পারব তা বুঝতে পারছি না।”
ভাস্করবাবুরা সরকারি হাসপাতাল থেকে যে সব কর্নিয়া সংগ্রহ করেন, সেই সব ব্যক্তির অধিকাংশেরই চক্ষুদানের অঙ্গীকার করা থাকে না। আত্মীয়স্বজনকে বুঝিয়ে ওই সব কর্নিয়া সংগ্রহ করা হয়। রাজ্যের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে গিয়ে তাই এই প্রচার করতে চান বলে ভাস্করবাবু জানিয়েছেন। তাঁর প্রশ্ন, “কিন্তু সরকার যদি সঠিক পরিকাঠামোই না দিতে পারে, তা হলে আমাদের এই প্রচেষ্টাই নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।”
এতে এক দিকে যেমন চক্ষুদানের আসল উদ্দেশ্য নষ্ট হচ্ছে, অন্য দিকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে লোক ও যানবাহন পাঠিয়ে চোখ সংগ্রহ করে আনতে যে বিপুল পরিমাণ সরকারি টাকা খরচ হচ্ছে, তারও উপযোগিতা থাকছে না। জেলায় চোখ সংগ্রহ ও গ্রাফটিংয়ের পরিকাঠামো তৈরির বহু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর। কিন্তু তারা কিছুই করে উঠতে পারেনি। রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা সিঞ্চতা বক্সীর বক্তব্য, “সমস্যাটা রয়ে গিয়েছে। আমাদের এখনও তেমন পরিকাঠামো নেই যে, জেলা হাসপাতালে গ্রাফটিং বা চোখ সংগ্রহের ব্যবস্থা করতে পারব। তৈরি হতে সময় লাগবে। দক্ষ চিকিৎসকও তো দরকার। আেস্ত আেস্ত সব হবে। রায়গেঞ্জ শুরু হয়েছে। কিছু গ্রাফটিং সেখানে হচ্ছে।”
মানুষের উৎসােহ অবশ্য খামতি নেই। প্রচুর লোক ‘প্লেজ কার্ড’-এ সই করে অঙ্গীকার করছেন। সোমবারেও মানিকতলা মেন রোডের বাসিন্দা চিরঞ্জীব ও গীতশ্রী দেব তাঁদের বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে আরআইও-তে এসে চক্ষুদানের অঙ্গীকারপত্রে সই করেন। এই পর্যন্ত সবই চমৎকার। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলে কারও মৃত্যু হলে অঙ্গীকার করা থাকলেও সেই চোখ কাজে লাগানো যাবে তো? এই প্রেশ্নর জবাব নেই। এক বছরে ৭৫০ চোখ পাওয়ার পরেও তো আরআইও-তে কয়েক মাস ধরে ৪৩ জন মানুষ হত্যে দিয়ে পেড় রয়েছেন একটা ‘ভাল’ চোখের জন্য।
সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯
Leave a Reply