চার পাশের দেয়াল ইট, সিমেন্ট আর বালুর যৌথ আস্তরণ আমাদের জীবনকে কংক্রীটময় করে তুলছে। আকাশ ছোঁয়ার ব্যস্ততায় আমাদের আছে অসংখ্য ফুটওভার আর দু’টো ফ্লাইওভার। গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে ফেরারী আর ৬ নম্বর বাস দু’টোই আমরা চালাব খুব তাড়াতাড়ি পাশাপাশি। শপিং ম্যানিয়াক না হয়েও এই মেট্রোপলিটন লাইফে আছে শ’খানেক শপিংমল। কাঁচা বাজারের ঝুট ঝামেলা এড়াতে আমরা অভ্যস্ত হচ্ছি মেট্রো স্টাইলে অগোরা কিংবা নন্দনে। তবে কি সত্যি আমরা বদলে যাচ্ছি জীবন যাপনে ? বাঙালির এই পরিবর্তন ঘটছে এমন কি বৈশাখী স্টাইলেও। তাই নিয়ে লিখেছেন তামান্না শারমীন
যে কিশোরটি গিটার আর ড্রামস বাদে মিউজিক কি এ সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখত না, সেও যখন হাতে একতারা বা গলায় ঢোল বেঁধে নেয় তখন বুঝতে হবে আকাশে ঝড়ো মেঘ জমেছে। স্বর্ণ কিংবা সিলভার নয় কিশোরীর কানে যখন উঠে আসে মাটির গহনা তখন বিশ্বাস প্রগাঢ় হয় বাইরে রোদের তাপ বেড়েছে, নইলে কিশোরী কেন মাটির শীতল স্পর্শ পেতে চাইবে ? বসনে যদি রঙের বন্যা লাগে তখন বুঝতে হবে বৈশাখ এসেছে। আসলে বৈশাখ শুধু আমাদের কাছে নতুন বছরের শুরু নয়, বৈশাখ মানে জীবনের নতুন স্পন্দন। বৈশাখ মানেই লাল, লাল মানেই পরিবর্তন আর বিস্মরণের আলামত। বৈশাখ মানেই ঝড় আর ঝড় মানেই পুরোনোকে ভেঙে চুড়ে নতুনের অবস্থান। বৈশাখ মানেই বাঙালির আটপৌড়ে জীবনে লালের দাপট, ঝড়ের সংকেত আর নতুনের আবাহনে স্টাইলিশ লাইফ।
বাঙালি জীবনকে বার ভাগে ভাগ করলে তার শুরুটা বৈশাখে। ইংরেজি বর্ষপরিক্রমায় আমরা যার শুরুটা ধরি ১৪ এপ্রিল থেকে। অথচ ইতিহাস কিন্তু অন্যরকম। প্রথম বাংলা বছর পালন শুরু হয়েছিল ১৫৮৪ সালের ১০ মার্চ। শুরুর সেই ধাপটা কিন্তু অদ্ভূত। অন্যের জন্য আমাদের জাতিসত্বার প্রতিটি ইতিহাস যেমন ভিন্ন তেমনি বাংলা নববর্ষের শুরুটাও ভিন্নতার সন্ধান দেয়। আমরা তখন মোঘল শাসনাধীন। মোঘলদের
তাই প্রতিনিয়ত মোঘলদের খাজনা দিতে হয়। আর পুরো বিষয়টা মোঘলরা নির্ধারণ করতো হিজরী ক্যালেন্ডার অনুযায়ী। যার নাম ছিল তখন ফসলী বছর। তবে এ খাজনা আদায়ের হিসাবে নানা সমস্যা দেখা দিল হিজরী সনের সীমাবদ্ধতায়। তাই সম্রাট আকবরের শাসনকালে নতুন ফসলী সনের প্রবর্তন করা হল যার নাম রাখা হল বঙ্গাব্দ। পরবর্তীতে সেই বঙ্গাব্দ ররূপ পেল বাংলা নববর্ষ হিসেবে। বাংলা নববর্ষের উদযাপন শুরু হল আকবরের শাসন আমলে। পহেলা বৈশাখ প্রথম উদযাপিত হল চৈত্রের সমাপ্তিতে সব খাজনা পরিশোধের আনন্দে। আর মোঘলরা আনন্দিত হল আরেকটি নতুন বছরের খাজনা প্রাপ্তির প্রত্যাশায়, নতুন খাজনার খাতা খুলল তারা, যার নাম দিল হালখাতা। একপক্ষ উৎসব করছে দায়মুক্তির আর অন্যপক্ষ উল্লাসে মেতে উঠছে নতুন দিনের দায় পাবে এই আশায়। দুই প্রাপ্তির মিলনের ফলেই এই প্রথম বাঙালী এক এমন উৎসব পেল যাতে অংশগ্রহণ থাকল সর্বশ্রেণীর। আমরা পেলাম পহেলা বৈশাখ। আমরা জাতিগত ভাবে অর্থনৈতিক চেতনায় উদাসীন হলেও আমদের এই নতুন বছর শুরু করার চেতনা আসল অর্থনৈতিক চিন্তা চেতনার সঙ্গে সংযুক্ত হয়েই। তাই পহেলা বৈশাখমানেই হালখাতা, বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের কাছে। আর গ্রাম বাংলার প্রতিটি মানুষের কাছে বৈশাখ মানেই পার্বণ। নতুন ফসলের ঘ্রাণ নেবার সময়, উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে উঠা আর সবার কাছে একটাই লক্ষ্য মেলায় যাওয়া। মূলত পহেলা বৈশাখ মানেই বাঙালীর মিলন মেলা। মিষ্টি স্বাদের খাবার আর নানা পিঠা, পায়েশ সন্দেশের আয়োজন- বাঙালীর অতিথি পরায়ণতাকে আরও একবার শানিয়ে নেয়। একসময় ছিল পহেলা বৈশাখ মানেই ছিল যাত্রা, পালা গান, কবিগান, জারিগান, গম্ভীরাগান, গাজীর গান আর আলাপ গানের আসর। আর এসব গানের সঙ্গে পাল্লা দিত আমাদের লোকায়ত ঐতিহ্যের বাউল গান, মারফতী, মুর্শিদী এবং ভাটিয়ালী গান।
বাংলা নববর্ষের প্রতিটি আয়োজনে ছিল এক ভিন্ন ধারার আখ্যান, তাই বাংলাদেশের একেক অঞ্চলে বৈশাখ উদযাপনে একেক ভাবধারা পরিলক্ষিত হয়। কোথাও চলত পূণ্য উৎসব, ঢাকায় চলত ঘুড়ি উৎসব, মুন্সিগঞ্জে চলত ষাড়ের দৌড়, চট্টগ্রামে হত বালির লড়াই বা রেসলিং আর রাজশাহীতে হত গম্ভীরা।
এছাড়া গ্রাম-গঞ্জে অঞ্চল ভেদে নানারকমের মেলা আর উৎসবের প্রচলনতো ছিলই। আমাদের পারিবারিক অবকাঠামোতে পহেলা বৈশাখ এক ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে নতুন জামাই তার স্পেশাল আপ্যায়ন পেতেন এই সময়টাতেই। বৈশাখের এই প্রথম দিনটিতে সবার আনন্দ প্রকাশ পায় একটু অন্যভাবে নতুন শাড়ি আর পাঞ্জাবীতে নিজেদের জাতীয় পোশাকের ধ্যানধারণায় মেতে উঠে বাঙালি নরনারী। রঙ আর আলোর প্রাচুুর্যে এই সময় পোশাক হয়ে উঠে বর্ণিল। হাতভর্তি কাচের চুড়ি, অন্য অলংকারে মাটির ছোঁয়া, কপালে লাল সূর্য রঙা টিপ, চারিদিকে ঢোল ঢাকুরের শব্দ ইত্যাদি সবকিছু মিলিয়ে এক অন্যরকম পার্বণ- এই তো আমাদের ঐতিহ্যমণ্ডিত পহেলা বৈশাখ।
বৈশাখ এখন তার স্টাইল পাল্টে ফেলেছে। অবাক লাগছে, আসলে আমরা নিজেরাই পাল্টে ফেলছি নিজেদের চিরায়ত এই প্রথাকে। আমাদের লোকজ এই ক্ষণটিকে মেট্রোলাইফে আমরা রূপান্তর করে নিয়েছি। জাতি হিসেবে আমাদের আধুনিকতা, পারিপার্শ্বিক বিচার, স্যাটেলাইট আগ্রাসন আর বিশ্বায়নের প্রভাবে আমাদের পহেলা বৈশাখ এখন উঠে এসেছে পোশাকে, টিভি চ্যানেলে, বখাটে ছেলের রমনার বটমূলে ছুটে যাওয়ায়, চারুকলার একদল পাগলপ্রায় তরুণদের ুউদ্দীপনায় আর হাজার হাজার মানুষের রাজপথের ঢলে। এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় বৈশাখের এই নাগরিক রূপ এখন অনেক বেশি বর্ণাঢ্য। এতে প্রাণের ছোঁয়া তো আছেই, সঙ্গে বাড়তি পাওনা হিসেবে থাকছে একটি বিশেষ দিনকে বিশেষ রূপে গ্রহণ করার মানসিকতা।
পহেলা বৈশাখ আমাদের কাছে অর্থাৎ মেট্রোপলিটন লাইফে যতটা না পার্বণ তার চেয়ে অনেক বেশি কার্নিভাল। তাই এর লোকায়ত রূপে আমরা দিয়েছি কঠিন চারদেয়ালের স্পর্শ। সেই স্পর্শের যাতনায় পহেলা বৈশাখ এখন ছুটে চলছে রমনায় ছায়ানটের গান শুনতে, কিংবা মেলা, রেস্টুরেন্ট অথবা ক্যাফেতে বসে পান্তা ইলিশ আর পেঁয়াজ কুচি খেতে, কখনো কখনো আমরা ছুটছি ভোর সকালে মুখোশ হাতে আনন্দ র্যালিতে, গানপাগল তরুণরা চাইছে ওপেন এয়ার কনসার্ট, সানসিল্ক খুঁজে চলছে রমনা বটমুলে কিংবা চারুকলা চত্বরে সুন্দরী সৌভাগ্যবতী রূপসীদের। স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো পুরো একদিন পাল্টে দিতে চাচ্ছে তাদের নিয়মিত কর্মসূচী, দর্শককে বন্দী করতে চাইছে বৈশাখি স্টাইলে। বুটিক হাউজগুলো তাদের ফ্যাশন চর্চায় আর স্টাইল তৈরিতে ব্যবহার করছে বৈশাখকে এক নতুন বাণিজ্যিক স্টাইলে। আমাদের মতো পাক্ষিক কিংবা দৈনিক পত্রিকাগুলো মেতে উঠছে পহেলা বৈশাখের বিশেষ সংখ্যায়। তাই বৈশাখ স্টাইল এখন আর আম জনতার নয়, ফ্যাশন ডিজাইনার, টিভি প্রোডিউসার, আর্টিস্ট, সেলিব্রেটি, জার্নালিস্ট, ক্যামেরা ম্যান ইত্যাদি সবার কাছে বৈশাখ এখন বাড়তি রূপ ধারণ করেছে। বৈশাখ মানেই খানিকটা উত্তাপ। উত্তাপ মানেই লাল রঙের আকুতি। পরনে সুতি তবুও রঙের উত্তাপে আমাদের মাঝে যে মোহ সঞ্চারিত হয় তার কারণে আগামী বছরেও হয়তো বৈশাখে নতুন স্টাইল সংযোজিত হবে। আমরা নিজেদের খুঁজে পাব নতুন রূপে।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, এপ্রিল ১৩, ২০১০
Leave a Reply