দুঃসহ এই গরমে মানুষ যেন বাতাসের আশায় উন্মুখ হয়ে থাকে। তপ্ত রোদে পথচলা পথিক থেকে শুরু করে সবাই বারবার তাকায় আকাশের মেঘ আর গাছের পাতার দিকে। যদি শরীর জুড়ায় সিগ্ধ বাতাসে, এই প্রত্যাশায়। হতাশ হয়ে সবাই গরমের সখা হাতপাখাকে বেছে নেন। শুরু হয় প্রশান্তির অনুভব।
‘আমার নাম তালের পাখা শীতকালে দেইনা দেখা, গ্রীষ্মকালে প্রাণের সখা’-এটি আমাদের দেশের গ্রাম বাংলার একটি প্রাচীন লোকগাঁথা। কার্যতই আজও গরমে আমাদের তালের পাখার উপর নির্ভর করতে হয়। যদিও জীবন এগুচ্ছে দ্রুত। বাড়ছে যন্ত্রের আধিক্য। তারপরে প্রতিদিন বিদ্যুৎ বিভ্রাটে অতিষ্ঠ নগর জীবনে সঙ্গী করে নিতে হয় হাতপাখা। তাই তো আজকাল অভিজাত বুটিক বাড়ি কিংবা ফ্যাশনহাউজগুলোও নজর দিচ্ছেন বাহারি হাত পাখার উপর। এসব হাতের পাখা নানা ঢং আর রঙ-এ চলে আসছে অভিজাত ড্রইং রুমের সৌন্দর্য বৃদ্ধির উপকরণ হয়ে। তাই আজ আর হাত পাখা শুধু হাওয়া খাওয়ার জন্য নয়, আরও বেশি কিছুতে পরিণত হয়েছে। তালপাখা সম্পর্কে অভিজাত বুটিক সপগুলোর ডিজাইনাররা ভাবছেন নতুন করে। তাদের মধ্যে দেশীয় উপকরণ আর ঐতিহ্যের উপর আজ মানুষ ঘুরে ফিরে যাচ্ছে। এতে তাদের রুচি ও আভিজাত্যের প্রকাশ ঘটে বলে তারা মনে করেন। তাই ড্রইং রুমে ক্রিস্টালের দামী সোপিস এর সাথে বাহারি হাতপাখা আর বেমানান নয়।
পাখা তৈরী
হাত পাখার ক্ষেত্রে তালের পাখার ব্যবহার বরাবরই এগিয়ে। তালের পাতায় নানা রঙের ডিজাইন করা পাখাও পাওয়া যায়। তাছাড়া গ্রামের অনেক মেয়েরাই পাটি পাখা, কাপড়ের নকশা করা পাখা, সুতায় বোনা পাখাসহ নানা রকম পাখা তৈরি করে। ব্যবসায়িক ভিত্তিতে এসব পাখা তৈরি হয়ে থাকে। প্রাচীনকালেও এ উপকরণে হাত পাখা তৈরি হতো। তবে আজকাল রকমফেরের আধিক্য দেখা যায়।
যে সব এলাকায় পাখা তৈরী হয়
পাখা তৈরির জন্য কিশোরগঞ্জ, কৈতরকান্দি, নারায়ণগঞ্জ, সোনারগাঁ, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল করটিয়া, খুলনা, বাগেরহাট, যশোর বরিশাল প্রসিদ্ধ। তাছাড়া, নওগাঁ, নোয়াখালি ও ঢাকার কিছু কিছু অঞ্চলে পাখা তৈরী হয়।
তালপাখা
নওগাঁ, ঢাকা, নোয়াখালীর হাতপাখা বিখ্যাত। তাল গাছের বেশ বড় পাতাসহ কেটে বিভিন্নভাবে প্রক্রিয়াকরণ করে তাল পাখা তৈরি করা হয়। সাদামাটা এই পাখাগুলো সর্বত্রই পাওয়া যায়। ১৫ টাকা থেকে শুরু করে স্থান ভেদে ২৫ টাকা পর্যন্ত তাল পাখার দাম হতে পারে। ফার্মগেটের ফুটপাতে তালপাখা বিক্রেতা করিম মিয়া জানান, গরমে বড় তালপাখার সাথে ছোট ছোট তাল পাখার চাহিদা বেশি। স্কুল-কলেজের সামনে অপেক্ষমান অভিভাবকগণ প্রচন্ড গরমে স্বস্তি পেতে হাতে তুলে নেন ছোট পাখা। এগুলোর দামও কম। সাধারণত গাজীপুর অঞ্চল থেকে এই পাখাগুলো আনা হয়।
বিভিন্ন রকম পাখা
তালপাখার পাশাপাশি কাপড়ের পাখার ঐতিহ্যও প্রাচীন। গ্রাম বাংলার ভিন্ন মেলার গন্ডি পেরিয়ে আজ নগর জীবনের মেলাগুলোতেও বিভিন্ন রকম কাপড়ের পাখা দেখতে পাওয়া যায়। খুলনা, বাগেরহাট, সিলেট ও বরিশাল অঞ্চলে কাপড়ের নকশি পাখাগুলো পাওয়া যায়। চৈত্র মাসের আগেই এসব এলাকার মেয়েরা পাখা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। পুরনো কাপড়ে রঙ দিয়ে তাতে নানা রঙের সুতার কাজ করে পাখা তৈরি হয়। অনেক পাখায় ঝালরও লাগানো হয়। পাখার ডাটিতে আছে বৈচিত্র্য। অনেক পাখায় বাঁশের একটা চোঙ দেয়া থাকে। এতে পাখাটি ঘোরাতে সুবিধা হয়। এ সকল বাহারি পাখা ঘর সাজানো ও উপহার দেবার উপকরণ হিসেবেও ব্যবহার হয়।
যশোর ও নারায়ণগঞ্জ-এ সুতোয় বোনা পাখা পাওয়া যায়। নানা রকম ও রঙের সুতা ব্যবহার করে এই পাখাগুলো তৈরি হয়। মেলা পার্বণে এই পাখার কদর বেশি। আড়ং সহ অনেক ফ্যাশন হাউজে এই পাখা পাওয়া যায়। সুতোয় বোনা পাখার দাম একটু বেশি। তবে ৩০০ টাকার ভিতর একটি পাখা পাওয়া যাবে।
আরও আছে
এসব পাখা ছাড়া আছে শোলা ও বেতের পাখা, পাটির পাখা প্রভৃতি। আজকাল কাগজ ও প্লাস্টিকের হাত পাখারও একটা বাজার চাহিদা আছে।
নানান নাম
পাখা যে শুধু দেখতে বাহারি তা কিন্তু নয়, পাখার রয়েছে নামেরও নানান বাহার অঞ্চল ভেদে কিছু পাখাকে ভালবাসা, শঙ্খলতা, মানবিলাসী, বাঘাবন্দী, হাতফুল মানবাহার, পালং পোষ, কাঞ্চন মালা, মন সুন্দরী লেখা ইত্যাদি নামে ডাকা হয়। মূলত নকশার ভিত্তিতেই এ রকম নাম দেয়া হয়। অনেক পাখার গায়ে নানা রকম ছন্দ কবিতা ও স্থান পায়।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, এপ্রিল ১৩, ২০১০
Leave a Reply