বাতজ্বর মূলত শিশু-কিশোরদের রোগ। খুব অল্পসংখ্যক ক্ষেত্রে বড়দেরও হতে পারে। বাংলাদেশে বাতজ্বর সাধারণত পাঁচ থেকে ২২ বছর বয়সীদের হয়ে থাকে। বাতজ্বরে হৃদযন্ত্র আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই সন্তানের বাতজ্বর হয়েছে শুনলে অনেক মা-বাবাই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। বাতজ্বর থেকে বাঁচার অনেক উপায় রয়েছে। উপায়গুলো বুঝতে হলে বাতজ্বরের কারণ সম্পর্কে জানতে হবে।
গলাব্যথা থেকে বাতজ্বর
আমরা প্রায়ই গলাব্যথায় ভুগে থাকি। গলাব্যথার অধিকাংশ হয়ে থাকে ভাইরাসের কারণে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এর কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না, এমনিতেই সেরে যায়। আর ব্যাকটেরিয়াজনিত গলদাহ মূলত স্ট্রেপটোকক্কাস দিয়ে হয়ে থাকে। এটিকে সংক্ষেপে ‘স্ট্রেপ’ বলা হয়। এটিই বাতজ্বরের কারণ। সময়মতো এই গলদাহের সঠিক চিকিৎসা না নিলে বাতজ্বর হতে পারে।
ভাইরাসজনিত গলদাহঃ ভাইরাসজনিত গলদাহ আস্তে আস্তে শুরু হয়। সারা শরীর ম্যাজম্যাজ করে। এই গলদাহে সর্দি ও কাশি থাকে। কাশতে কাশতে শ্বাসকষ্টও হতে পারে, চোখ লাল হয়ে যেতে পারে, চোখ থেকে পানি পড়তে পারে, কণ্ঠস্বর ভেঙে যেতে পারে। এই গলদাহ সাধারণভাবে ‘ঠান্ডা লাগা’ হিসেবে পরিচিত।
স্ট্রেপজনিত গলদাহঃ স্ট্রেপ জীবাণু নিঃশ্বাসের সঙ্গে মানুষের গলায় প্রবেশ করে বাসা বাঁধতে পারে। এরপর রোগী জ্বরসহ গলাব্যথায় ভোগে। এমনিতেই ভালো হয়ে যায় বলে অবহেলা করে অনেকে গলাব্যথার চিকিৎসা নেয় না। গলাব্যথার তীব্রতা কম হলে তো কথাই নেই। ভুলটি হয়ে থাকে এখানেই। শতকরা ১৫ থেকে ২০ ভাগ গলাব্যথা হয়ে থাকে স্ট্রেপের কারণে। গলদাহ প্রধানত শিশু-কিশোরদের হয়ে থাকে। ব্যথার মাত্রা কম হলে তারা মা-বাবাকে সমস্যার কথা জানায় না। ফলে তারা চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত থাকে। অন্যদিকে স্ট্রেপ গলদাহ নিজে নিজে ভালো হয়ে যায় বলে অনেকেই একে গুরুত্ব দেয় না এবং চিকিৎসা করায় না। এতে কেউ কেউ বাতজ্বরের শিকার হয়। এই গলদাহের মূল উপসর্গ হচ্ছে গলায় ব্যথা, যা মূলত ঢোক গেলার সময় হয়ে থাকে। ব্যথা হঠাৎ করে শুরু হয় এবং সঙ্গে জ্বর থাকে (সাধারণত ১০১ থেকে ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট)।
রোগীকে হাঁ করিয়ে পরীক্ষা করলে টনসিল ও গলবিল লালচে দেখা যাবে। আলাজিহ্বা লাল হয়ে ফুলে যাবে। এমনকি রক্তক্ষরণের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দাগও দেখা যেতে পারে। বলে রাখা ভালো, টনসিলের প্রদাহ থেকে বাতজ্বর হতে পারে। গলার সামনে অবস্থিত টনসিলের লিম্ফগ্রন্থি বড় হবে এবং চাপ দিলে ব্যথা হবে।
গলার শ্লে্না ‘কালচার’ (জীবাণু নিরীক্ষণ) করলে স্ট্রেপ পাওয়া যেতে পারে। সমস্যা হচ্ছে, এ পরীক্ষাটিতে দু-তিন দিন সময় লেগে যায়।
যেসব উপসর্গ দেখা দিতে পারে
স্ট্রেপ গলদাহের চিকিৎসা না নিলে কয়েক সপ্তাহ পর কেউ কেউ আবার অসুস্থ বোধ করবে। এই অসুস্থতাই বাতজ্বর। জ্বর হবে, বড় বড় গিরায় (বিশেষত হাঁটু, গোড়ালির গাঁট, কনুই ও কবজি) ব্যথাসহ ফোলা দেখা দেবে। এই ব্যথা বেশি দিন থাকে না, এমনকি চিকিৎসা না নিলেও। এখানে আরেকবার ভুল করে বসে অনেকেই। নিজে নিজে গিরাব্যথা ভালো হয়ে যায় বলে চিকিৎসা না নিয়েও অনেকে আশ্বস্ত থাকে। এই স্বস্তি পরে অস্বস্তি ডেকে আনে। বাতজ্বরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে হৃদযন্ত্রের কপাটিকার প্রদাহ। তবে এটি এ দেশে মাত্র এক-পঞ্চমাংশ রোগীর বেলায় ঘটে থাকে। যাদের হৃৎপ্রদাহ হয়, তাদের অনেকেই হৃৎপ্রদাহের কোনো উপসর্গ টের পান না। কারও কারও ক্ষেত্রে বুক ধড়ফড় ও শ্বাসকষ্ট হতে পারে। জ্বরের মাত্রার তুলনায় রোগীকে বেশি অসুস্থ মনে হবে। এ ছাড়া বাতজ্বরের আরও তিনটি বিরল লক্ষণ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে, নিয়ন্ত্রণহীন অঙ্গ সঞ্চালন, ত্বকের নিচে ব্যথাহীন গোলমতো গোটা এবং ত্বকে বড় লালচে দাগ হওয়া।
বাতজ্বর থেকে হৃদরোগ
বাতজ্বরে হৃদযন্ত্র আক্রান্ত হওয়ার পরও বেশির ভাগ রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়। স্বল্পসংখ্যক রোগীর হৃদযন্ত্রের কপাটিকার স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে। এ অবস্থাকেই বাতজ্বরজনিত হৃদরোগ বলে। যারা বারবার বাতজ্বরে আক্রান্ত হয় তাদের বাতজ্বরজনিত হৃদরোগ হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। ফলে রোগীর শ্বাসকষ্ট, বুক ধড়ফড় ও কাশি হতে পারে এবং পানি জমার কারণে পায়ের পাতা ফুলে যেতে পারে। রোগী অল্পতেই হাঁপিয়ে ওঠে, কর্মক্ষমতা কমে যায়, এমনকি অকালে মৃত্যুও হতে পারে।
বাতজ্বর থেকে বেঁচে থাকার উপায়
বাতজ্বর থেকে বাঁচার জন্য তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সঠিক পুষ্টি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং গলদাহ হলে সময়মতো এর চিকিৎসা করা।
শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত করুনঃ শিশুর শরীরের পুষ্টিমান সঠিক হলে গলায় জীবাণু ঢুকলেও বাতজ্বর হওয়ার আশঙ্কা কম। অপুষ্টি বাতজ্বরের সূতিকাগার। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ছোটবেলায় দীর্ঘদিন ধরে অপুষ্টিতে ভোগে তাদের বাতজ্বরের আশঙ্কা বেশি। যারা সয়াবিন তেল খায়, তাদের সরিষার তেল ব্যবহারকারীদের তুলনায় বাতজ্বর কম হয়। যেসব শিশুর রক্তে আমিষ ও লৌহের অভাব রয়েছে, তাদের বাতজ্বর হওয়ার আশঙ্কা বেশি। তাই শিশুর সঠিক পুষ্টি নিশ্চিত করা জরুরি।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকুনঃ ‘স্ট্রেপ’ জীবাণু নাক, গলা ও ত্বকে বাস করে। ঘনিষ্ঠভাবে অবস্থানকালে একজন থেকে অন্যজনে সঞ্চারিত হয়। তাই অনেক লোক একসঙ্গে গাদাগাদি হয়ে থাকলে স্ট্রেপের জন্ম ও সঞ্চালন বেশি হয়, বিশেষত লোকজন যদি অপরিষ্কার থাকে। ঘরদোর পরিচ্ছন্ন না থাকলেও স্ট্রেপ বাড়তে থাকবে। পরিবারের সবাই যদি প্রতিদিন সাবান দিয়ে গোসল করে এবং হাত ও নাক পরিষ্কার করে, তাহলে ঘরে স্ট্রেপ জীবাণুর পরিমাণ কমে যাবে। দৈনিক অন্তত একবার গড়গড়া করে গলা পরিষ্কার করে এগুলোর বিস্তার প্রতিহত করতে হবে। ঘরের আশপাশও পরিষ্কার রাখতে হবে।
বাতজ্বরের চিকিৎসা নিন
বাতজ্বরের চিকিৎসা সহজ ও সস্তা। পেনিসিলিন ও অ্যাসপিরিন দিয়ে এর চিকিৎসা করা যায়। হৃদযন্ত্র আক্রান্ত হলে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয়। প্রথম দিকে রোগীকে যথেষ্ট বিশ্রাম নিতে হয়। রোগের তীব্রতা কমা পর্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। খেলাধুলা করা যাবে না। স্কুলে না যাওয়াই ভালো। গেলেও শরীরচর্চা করা যাবে না।
বারবার বাতজ্বর থেকে বাঁচার উপায়
বাতজ্বরের আক্রমণের সংখ্যা যত বাড়বে, বাতজ্বরজনিত হৃদরোগ হওয়ার আশঙ্কা তত বেশি হবে। আর যাদের ভাল্ব ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের ভাল্ব আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই যারা বাতজ্বরে আক্রান্ত হয়েছে বা বাতজ্বরজনিত হৃদরোগে ভুগছে, তাদের তিন সপ্তাহ পর পর একটি বেনজাথিন পেনিসিলিন ইনজেকশন নিতে হবে অথবা দিনে দুবার পেনিসিলিন ট্যাবলেট সেবন করতে হবে। এ ব্যবস্থা দীর্ঘমেয়াদি। মোট পাঁচ বছর অথবা ২২ বছর বয়স হওয়া পর্যন্ত নিতে হবে। এর মধ্যে যেটি দীর্ঘতর হবে, সেটিই প্রযোজ্য হবে। যেমন যার বয়স ২০, তাকে নিতে হবে পাঁচ বছর, আর যার বয়স ১০, তাকে নিতে হবে ১২ বছর। যাদের হৃদযন্ত্র আক্রান্ত হয়েছে, তাদের কমপক্ষে ১০ বছর অথবা ৩০ বছর বয়স হওয়া পর্যন্ত নিতে হবে (এর মধ্যে যেটি দীর্ঘতর হয়)। যাদের বাতজ্বরজনিত হৃদরোগ হয়েছে, এমনকি যারা ভাল্বের অস্ত্রোপচার করেছে, তাদের আজীবন নিতে হবে।
বাতসহ (গিরাব্যথা) জ্বর হলেই বাতজ্বর নয়ঃ গিরা ফোলা বা ব্যথাসহ জ্বর আরও বেশ কিছু রোগে হতে পারে। তাই গিরাব্যথা হলেই বাতজ্বর হয়েছে বলা যাবে না। তবে গিরা ফুলে গেলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। মনে রাখবেন, বাতজ্বরের গিরা ফোলা বা ব্যথা সহজেই ভালো হয়ে যায়। তাই চিকিৎসা নেওয়া সত্ত্বেও যদি কোনো রোগীর গিরাব্যথা ভালো না হয়, তাহলে রোগটি বাতজ্বর না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। বাংলাদেশে যারা বাতজ্বরের চিকিৎসা নিচ্ছে, তাদের অধিকাংশই এ ধরনের রোগী।
এএসও টাইটার বেশি মানেই বাতজ্বর নয়ঃ বাতজ্বর নির্ণয়ের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট রক্ত পরীক্ষা নেই। গবেষকেরা অনেক চেষ্টা করেও বাতজ্বরের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট পরীক্ষা আবিষ্কার করতে পারেননি। বাতজ্বর সন্দেহ হলে চিকিৎসকেরা রক্তের অ্যান্টি-স্ট্রেপটোলাইসিন-ও (এএসও) পরীক্ষা করে থাকেন। এএসও বেশি হওয়ার অর্থই বাতজ্বর নয়। স্ট্রেপ দ্বারা গলদাহ হলেই রক্তে এএসওর মাত্রা বাড়বে। বাতজ্বর হলে অবশ্যই উপরোল্লিখিত লক্ষণগুলো থাকতে হবে। লক্ষণ বা উপসর্গের অনুপস্থিতিতে এ ধরনের রক্ত পরীক্ষা মূল্যহীন। এ ছাড়া স্ট্রেপ গলদাহ হওয়ার পর হাজারে মাত্র একজন বাতজ্বরে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ দেশের বেশির ভাগ ল্যাবরেটরির রিপোর্টে এএসওর স্বাভাবিক মাত্রা অনূর্ধ্ব ২০০ লেখা থাকে। এ ধারণাটি মূলত উন্নত দেশের প্রাপ্তবয়স্কদের উপাত্ত থেকে এসেছে। এটি বাংলাদেশের শিশু-কিশোরদের জন্য সঠিক নয়। এ দেশের শিশু-কিশোরদের মধ্যে স্বাভাবিক অবস্থাতেই এএসও ৪০০ পর্যন্ত থাকতে পারে (বাংলাদেশে মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল বুলেটিন ২০০২, ২৮ঃ ১-৬)। প্রাপ্তবয়স্কদের স্বাভাবিক এএসও শিশুদের তুলনায় কম থাকে। তবে বাংলাদেশে এ বিষয়ে এখনো কোনো গবেষণা হয়নি।
উপসর্গ ভালো হলেও ওষুধ বন্ধ করা যাবে নাঃ উপসর্গ ভালো হয়ে গেলেই বাতজ্বরের প্রতিষেধক চিকিৎসা বন্ধ করা সঠিক নয়। বাতজ্বর একবার হলে বারবার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই বাতজ্বরে আক্রান্ত হলে নিয়মিত ও ক্রমাগত (চিকিৎসকের পরামর্শমতে) পেনিসিলিন ব্যবহার করতে হবে, যাতে পুনরায় বাতজ্বর না হয়। মনে রাখবেন, এই পেনিসিলিন গ্রহণ বাতজ্বরের পূর্ববর্তী আক্রমণের জন্য নয়। এটি ভবিষ্যতে বাতজ্বর না হওয়ার জন্য স্বল্পমেয়াদি টিকা হিসেবে কাজ করে।
বাতজ্বর ছোঁয়াচে নয়ঃ বাতজ্বর ছোঁয়াচে রোগ নয়। বাতজ্বরের রোগীর সঙ্গে থাকলে, খেলে, ঘুমালে, এমনকি ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করলেও বাতজ্বর হওয়ার আশঙ্কা নেই। গর্ভাবস্থায় মা থেকে শিশুতেও সংক্রমণের আশঙ্কা নেই। কিন্তু স্ট্রেপ গলদাহের সময় কাছাকাছি থাকলে, কথা বললে গলদাহ হতে পারে। তাই যে শিশুর গলাব্যথা আছে, তার সঙ্গে সুস্থ শিশুকে মিশতে দেবেন না।
বাতজ্বর হলেও গর্ভধারণ করা যায়ঃ মেয়েদের বাতজ্বর হলে বিয়ে বা সন্তান ধারণে অসুবিধা নেই। গর্ভধারণ করলেও পেনিসিলিন চালিয়ে যেতে হবে। এতে সন্তানের কোনো ক্ষতি হবে না। তবে এ অবস্থায় কোনো কোনো চিকিৎসক ইনজেকশনের পরিবর্তে ট্যাবলেট খাওয়ার উপদেশ দিয়ে থাকেন। বাতজ্বরজনিত হৃদরোগ থাকলেও গর্ভধারণ করা যায়, যদি হৃদযন্ত্রের ভাল্ব বেশি পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়ে থাকে। বাতজ্বরজনিত হৃদরোগ গুরুতর হলে সন্তান নেওয়া মায়ের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। তাই বাতজ্বরজনিত হৃদরোগীরা গর্ভধারণের আগে বাতজ্বরে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।
ডা· এম মোস্তফা জামান
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও রোগতত্ত্ববিদ
(অসংক্রামক ব্যাধি)
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ২৫, ২০০৯
Leave a Reply