আমার এক অনুজপ্রতিম সহকর্মী হৃদরোগীদের জন্য চিলেশন বা কিলেশন থেরাপি নিয়ে প্রথম আলোর স্বাস্থ্যকুশল পাতায় ২১ জানুয়ারি একটি নিবন্ধ লিখেছেন, যা হৃদরোগীর মনে একটি নতুন আশার সঞ্চার করেছে। অনেক করোনারি হৃদরোগের রোগী, যাঁদের আমি এনজিওগ্রামের পর বাইপাস সার্জারি অথবা এনজিওপ্লাস্টি করার জন্য সুপারিশ করেছি, তাঁরা আমার কাছে সেই প্রকাশিত নিবন্ধের পেপার কাটিং নিয়ে ছুটে এসেছেন। কিলেশন থেরাপি কী, জানতে চেয়েছেন। বাইপাস বা এনজিওপ্লাস্টি না করে বাংলাদেশে কিলেশন থেরাপি নেওয়া যাবে কি না এবং এর ফলাফল কী-এসব প্রশ্ন ব্যাকুলভাবে করে যাচ্ছেন। আমার সহকর্মী কিলেশন থেরাপি সম্পর্কে আশার বাণী শুনিয়েছেন। অগণিত রোগীর কৌতূহল সৃষ্টি করতে পেরেছেন, কিন্তু এটা কী পদ্ধতি, বাংলাদেশে তা শুরু হয়েছে কি না বা এর আনুষঙ্গিক খরচ ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আলোকপাত করেননি। তাই এ ব্যাপারে আগ্রহী রোগীদের কৌতূহল মেটাতে কিলেশন থেরাপি নিয়ে কিছু কথা বলা দরকার।
কিলেশন থেরাপি হলো, এক ধরনের কিলেটিং এজেন্ট ব্যবহার করে শরীর থেকে ভারী ধাতব পদার্থ সরিয়ে ফেলা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লিড পয়জনিংয়ে (সিসার বিষক্রিয়া) আক্রান্ত নৌবাহিনীর সদস্যদের শরীর থেকে লিড সরিয়ে ফেলার জন্য ইথাইলিন ডাই-অ্যামাইন টেট্রা-অ্যাসিটিক এসিড (ইডিটিএ) নামের সিনথেটিক অ্যামিনো এসিডের ব্যবহার শুরু হয়।
১৯৯৮ সালে আমেরিকান কলেজ অব অ্যাডভান্সমেন্ট ইন মেডিসিন আমেরিকার ফেডারেল ট্রেড কমিশনকে জানায় যে ইডিটিএ দিয়ে কিলেশন থেরাপি বিনা অস্ত্রোপচারে অ্যাথেরোসক্লেরোসিস চিকিৎসায় নিরাপদ ও কার্যকর। কিন্তু যাচাই করে দেখে যে এর কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। পরে ইউএস ন্যাশনাল সেন্টার ফর কমপ্লিমেন্টারি অ্যান্ড অলটারনেটিভ মেডিসিন করোনারি হৃদরোগে কিলেশন থেরাপির কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা গবেষণা কার্যক্রম হাতে নেয়, যাকে অনেকেই অপ্রয়োজনীয় ও ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে। তবে এই গবেষণার কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয় নৈতিক প্রশ্নে।
আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন প্রথম থেকেই কিলেশন থেরাপির কার্যকারিতা ও নিরাপত্তার ব্যাপারে যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই বলে সন্দেহ পোষণ করে।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথ ও আমেরিকান কলেজ অব কার্ডিওলজি একযোগে হৃদরোগীদের ওপর কিলেশন থেরাপিকে একটি বিপজ্জনক, অর্থহীন ও অপচয়কারী প্রচেষ্টা বলে মনে করে।
এত বিরোধিতা সত্ত্বেও আমেরিকান কলেজ অব অ্যাডভান্সমেন্ট অব মেডিসিন কিলেশন থেরাপি চালিয়ে যেতে থাকে এবং ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত তাদের কাছে আট লাখ রোগী কিলেশন থেরাপি নিয়েছে বলে দাবি করে। আর কিছু রোগীকে দিয়ে বিবৃতি দিতে থাকে যে এই পদ্ধতিতে তারা উপকৃত হচ্ছে। এর বিপরীতে আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের বক্তব্য হলো, কিলেশন থেরাপির সঙ্গে প্ল্যাসিভো থেরাপির কোনো পার্থক্য নেই। রোগীরা উপকৃত হওয়ার যে ভাষ্য দিচ্ছে, তা হয়তো আনুষঙ্গিক খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, ধূমপান ত্যাগ, ওজন নিয়ন্ত্রণ, জীবনযাত্রার আমূল পরিবর্তন ও পরিমিত ব্যায়ামের জন্য হচ্ছে। কিলেশন থেরাপি কীভাবে দেওয়া হয়, এর কার্যকারিতা, এর খরচের পরিমাণ ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী-এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন। কিলেশন থেরাপির প্রধান টার্গেট অ্যাথেরোসক্লেরোসিস। অ্যাথেরোসক্লেরোসিস হলো রক্তনালির দেয়াল শক্ত হয়ে যাওয়া। রক্তনালির দেয়ালে চর্বি, কোলেস্টেরল, ক্যালসিয়াম ও অন্যান্য পদার্থ জমা হয়ে অ্যাথেরোসক্লেরোসিস সৃষ্টি করে, যা রক্তনালির দেয়ালকে শক্ত করে দেয় এবং পরে রক্তনালি সরু হয়ে বা বন্ধ হয়ে রক্ত চলাচল বিঘ্নিত হয়। করোনারি (হার্টের রক্তনালি) অ্যাথেরোসক্লেরোসিসের পরিণাম হার্ট অ্যাটাক। মস্তিষ্কের রক্তনালির অ্যাথেরোসক্লেরোসিসের ফলে হয় মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ।
হৃদরোগীদের কিলেশন থেরাপি কীভাবে করা হয়ঃ
ইডিটিএ ওষুধটি লিড এবং মারকারি পয়জনিংয়েও ব্যবহার করা হয়। এটি অ্যাথেরোসক্লেরোসিস প্ল্যাক থেকে ক্যালসিয়াম সরিয়ে নেয় বলে ধারণা করা হয়। ফলে ওই প্ল্যাকের অন্যান্য পদার্থ ভেঙে যায় ও প্ল্যাক পরিষ্কার হয় এবং সরু বা বন্ধ রক্তনালি খুলে গিয়ে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হয়। কিলেশন থেরাপির প্রাথমিক ইনজেকশনটি দু-চার ঘণ্টাব্যাপী শিরায় দেওয়া হয়, যার খরচ তিন হাজার ৫০০ থেকে সাত হাজার টাকা।
প্রথম মাসে রোগীকে পাঁচ থেকে ৩০টি থেরাপি দিতে হয়, যার খরচ দুই লাখ ১০ হাজার টাকার মতো। এর পরও প্রতিমাসে একটি করে থেরাপি প্রতিষেধক হিসেবে নিতে পরামর্শ দেওয়া হয়। যার হিসাব দাঁড়াচ্ছে, প্রতিমাসে তাকে অন্যান্য ওষুধের খরচের সঙ্গে বাড়তি মাসিক সাত হাজার টাকা গুনতে হবে! অর্থাৎ কিলেশন থেরাপির খরচ বাইপাস সার্জারি ও এনজিওপ্লাস্টির খরচকে অনেক ছাড়িয়ে যায়।
কিলেকশন থেরাপি কতটুকু নিরাপদ
ইডিটিএ খুব নিরাপদ পদার্থ নয়। এর সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো, এটি কিডনিকে অকেজো করে দিতে পারে। পরবর্তী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো, অস্থিমজ্জা শুকিয়ে রক্তশূন্যতা, নি্ন রক্তচাপ, খিঁচুনি, হৃৎস্পন্দনে অনিয়ম, কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট, শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া, তীব্র অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া। এ ছাড়া জ্বর, বমি, পেটে ব্যথাসহ ছোটখাটো সমস্যা কিলেশন থেরাপিতে নিয়মিতই হয়ে থাকে।
কিলেশন থেরাপি নিয়ে যেসব গবেষণা হয়েছে
ষাটের দশকে ৩০ রোগীকে কিলেকশন থেরাপি দেওয়া হয়। থেরাপি চলাকালে দুজন রোগী মৃত্যুবরণ করলে এবং অপর ২৮ জনের মধ্যে কোনো উন্নতির লক্ষণ না পেয়ে এই গবেষণা কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। ২০০২ সালে জার্নাল অব আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনে আরেকটি গবেষণার ফলফলে দেখা গেছে, ৮৪ জন হৃদরোগীকে ২৭ সপ্তাহ ধরে কিলেশন থেরাপি দেওয়া হয়। গবেষণা প্রবন্ধের সমাপ্তি মন্তব্যে গবেষকেরা কিলেশন থেরাপির কোনো সুফল পাননি বলে মতামত ব্যক্ত করেন। ২০০২ সাল পর্যন্ত কিলেশন থেরাপি নিয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য গবেষণা নেই বলে এ থেরাপির সরাসরি বিরোধিতা করেছে আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন, আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন, এফডিএ, আমেরিকান কলেজ অব ফিজিশিয়ান, ন্যাশনাল হার্ট, লাং এবং ব্লাড ইনস্টিটিউশন, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ।
নতুন গবেষণা
আমেরিকার ন্যাশনাল সেন্টার ফর কমপ্লিমেন্টারি অ্যান্ড অলটারনেটিভ মেডিসিন, ন্যাশনাল হার্ট, লাং এবং ব্লাড ইনস্টিটিউশন যৌথ উদ্যোগে কিলেশন থেরাপির ওপর একটি গবেষণা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। এতে কিলেশন থেরাপির কার্যকারিতা, নিরাপত্তা ইত্যাদি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখা হবে। এ গবেষণায় এক হাজার ৯৫০ জন পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সের করোনারি হৃদরোগী নিবন্ধিত হবেন। এখানে এক গ্রুপ রোগীকে কিলেশন থেরাপি দেওয়া হবে এবং অন্য ভাগকে প্লাসিভো থেরাপি দেওয়া হবে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও রোগী জানবেন না রোগী কিলেশন থেরাপি পেল, না প্লাসিভো থেরাপি পেল। ২০টি আমেরিকান সেন্টারে এ গবেষণা একসঙ্গে চলবে। গবেষণায় ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বরে রোগী নিবন্ধন শুরু হয়েছে। গবেষণার সম্ভাব্য শেষ তারিখ জুলাই ২০১০।
আমাদের অবশ্যই কিলেশন থেরাপির ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গভাবে অবগত হওয়ার জন্য এ গবেষণার চূড়ান্ত ফল ও অভিমতের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
ডা· মো· আবু সিদ্দিক
অধ্যাপক, হৃদরোগ বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ২৫, ২০০৯
Leave a Reply