খুবই পরিচিত লতাগুল্ম। ত্রিফলা। এরই হিতকরী গুণ পরীক্ষা করে দেখেছিল পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের একটি গবেষক দল। তারা দেখেছিল, ইঁদুরের দেহে মানব-অগ্ন্যাশয় টিউমার গ্রাফ্ট করার পর সেগুলোকে ত্রিফলার রস খাওয়ানোয় সেই টিউমারের বাড়ন অনেক ধীর করে নিয়ে এল। ২০০৭ সালের এপ্রিলে আমেরিকার অ্যাসোসিয়েশন অব ক্যান্সার রিসার্চের বার্ষিক সভায় এই গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করে আশা প্রকাশ করা হলো যে একদিন এ দিয়ে একটি চিকিৎসা উদ্ভাবন সম্ভব হবে।
তবে বিশেষজ্ঞদের সতর্কবাণী হলো, গবেষণাটি এখনো সূচনা পর্যায়ে; ভারতবর্ষের সনাতন আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় ত্রিফলার ব্যবহার সর্বজনবিদিত। এতে রয়েছে তিনটি গাছের ফলের শুষ্ক চূর্ণ। পেটের অসুখ আরাম করতে, হজমের সহায়ক হিসেবে, যকৃতের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে এর ব্যবহার চলে আসছে।
ক্যান্সাররোধী গুণাগুণ
আগের গবেষণা থেকে দেখা গেছে, সেল কালচারে পাওয়া যায় ত্রিফলার ক্যান্সাররোধী গুণাগুণ। ইদানীং গবেষণায় ইঁদুরকে লতাগুল্ম খাইয়ে ক্যান্সার-কোষের বাড়ন কমানো গেছে, তবে সুস্থ অগ্ন্যাশয় কোষ এতে নষ্ট হয়নি।
মানব-অগ্ন্যাশয় টিউমার ইঁদুরের মধ্যে গ্রাফ্ট করে গবেষণা দল সেই ইঁদুরগুলোকে সপ্তাহে পাঁচ দিন ত্রিফলা দ্রবণ পান করায়।
চার সপ্তাহ পর তারা টিউমারগুলোর আয়তন এবং অন্তর্গত প্রোটিন তুলনা করে আরেক দল ইঁদুরের সঙ্গে, যেগুলোকে ত্রিফলার রস পান করানো হয়নি।
দেখা গেল, যেসব ইঁদুর ত্রিফলা পান করেনি সেগুলোর তুলনায় ত্রিফলা পান করেছে এমন ইঁদুরগুলোর টিউমারের আয়তন অর্ধেক হয়ে গেছে।
আরও দেখা গেল, যেসব ইঁদুর ত্রিফলা পান করেছে সেগুলোর টিউমার-কোষের প্রোটিন বেড়ে গেছে। কোন প্রোটিনগুলোর মান বেড়েছে? যে প্রোটিনগুলো ‘এপোপটসিস’ নামের একটি প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত সেগুলোর মান বেড়েছে। এপোপটসিস মানে তাহলে কী? এপোপটসিস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শরীর স্বাভাবিকভাবে বিনষ্ট, জরাগ্রস্ত, অবাঞ্ছিত কোষ বের করে দেয়। ক্যান্সার-কোষগুলোর মধ্যে অনেক সময় এপোপটসিস প্রক্রিয়াটি ত্রুটিপূর্ণ থাকে, তখন কোষের মৃত্যু ঘটে না, টিউমার-কোষ দ্রুত বাড়তেই থাকে।
এ গবেষণার মুখ্য ভূমিকা পালনকারী অধ্যাপক সনজয় কে শ্রীবাস্তব বলেন, ‘ত্রিফলা ক্যান্সার-কোষগুলোকে মরে যেতে উদ্দীপ্ত করে এবং কোষও বিষক্রিয়া না ঘটিয়েই টিউমারের আয়তন তাৎপর্যপূর্ণভাবে কমিয়ে আনে।’ আরও গবেষণা করে দেখা গেল, ত্রিফলা টিউমার-অবদমক জিনগুলোকে উদ্দীপ্ত করে, তবে স্বাভাবিক অগ্ন্যাশয়-কোষগুলোর ওপর নেতিবাচক কোনো প্রভাব ফেলে না।
অধ্যাপক শ্রীবাস্তবের ভাষ্য, ‘অগ্ন্যাশয়-টিউমার প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় একে একটি নির্দোষ এজেন্ট হিসেবে দেখার সম্ভাবনা দেখছি।’
প্রয়োজন নতুন চিকিৎসা
আমাদের দেশে অগ্ন্যাশয়-ক্যান্সারের হার জানা নেই, তবে বিলেতে ক্যান্সারে মৃত্যুর কারণ হিসেবে অগ্ন্যাশয়-ক্যান্সার ষষ্ঠ স্থানে। প্রতিবছর এ রোগে মারা যায় সাত হাজার ব্যক্তি। এর চিকিৎসা খুব কঠিন এবং বেঁচে ওঠাও বেশ কষ্টকর। এর হার বেশ কম। সবশেষ তথ্য থেকে জানা গেছে, রোগ নির্ণয় ও মৃত্যুর মধ্যে ফারাক হলো মাত্র ছয় মাস। বিশেষজ্ঞেরা বলেন, অগ্ন্যাশয় ক্যান্সারে নতুন চিকিৎসা সন্ধান করা গুরুত্বপূর্ণ, বর্তমান গবেষণা রয়েছে মাত্র সূচনা পর্যায়ে।
বিলেতের ক্যান্সার রিসার্চের কর্তাব্যক্তি ডা· এলিসন রস বলেন, অগ্ন্যাশয়-টিউমার চিকিৎসা কঠিন, তাই একে মোকাবিলা করার নতুন পথ সন্ধান করা গুরুত্বপূর্ণ। তবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা এখন শুরুর পর্যায়ে রয়েছে।
ত্রিফলা মানব-টিউমারে কার্যকর হয় কি না এ ব্যাপারে আরও অনেক কাজ করার আছে। যুক্তরাজ্যে চারটি অগ্ন্যাশয়-ক্যান্সারের প্রতিষ্ঠাতা সুয়ে বালার্ড বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে যেকোনো অগ্রগতিকে আমরা অভিনন্দন জানাব। কারণ অগ্ন্যাশয়-ক্যান্সারের জন্য নতুন নতুন চিকিৎসা খঁুজে বের করতে আরও অনেক চেষ্টার প্রয়োজন।’
লেখকঃ অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
দৈনিক প্রথম আলো, ০২ জানুয়ারী ২০০৮
Leave a Reply