আমাদের বর্ষবরণ সহস্র রঙে রাঙানো, অযুত ছটায় আঁকানো আর লাখো বাঙালিয়ানা প্রাণের বর্ণে-ঢঙে সাজানো। এখানে আনন্দ-উৎসবের কমতি নেই। নেই প্রাণের অভাব। আছে অপশক্তির ভয়-শঙ্কা জয় করার দৃঢ় প্রত্যয়। সে যদি আঘাত হানতে চায়, হানুক না; আমরা জয় করব আমাদের মঙ্গল শোভাযাত্রার মঙ্গলময় বার্তা দিয়ে। আমাদের পয়লা বৈশাখ উদ্যাপনের সুর মিশে আছে রমনার বটমূলে ছায়ানটের উৎসবে আর রং মিশে আছে চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রায়। এ দুটি আয়োজন নিয়েই আমরা মেতে উঠি নববর্ষ বরণে।
কী করে বোঝাই চারুকলার শোভাযাত্রাকে—এটা কি মঙ্গলময় বার্তাবাহক, না সাম্প্রদায়িকতা আর মৌলবাদ শক্তির প্রতি আমাদের পাল্টা জবাব, না আমাদের এই প্রজন্মের মানববন্ধন? অবশ্য চারুকলার শিক্ষার্থীরা মনে করেন অন্য কিছু—শতবর্ষের একটা বাঙালি ঐতিহ্য, চারু ও কারুশিল্পীর নির্যাস, চারুকলার শিল্পকর্ম আর আমাদের বাঙালিয়ানা—সব এক হয়ে হঠাৎ রাজপথে নেমে মঙ্গলের বার্তা ছড়িয়ে দেয় এই শোভাযাত্রা। শোভাযাত্রায় তাই কখনো আমরা আনন্দ-নৃত্যে মেতে উঠি, কখনো গাই উল্লাসের গান, কখনো ধিক্কার জানাই মৌলবাদকে, কখনো ক্ষোভে কালো কাপড় জড়াই সাম্রাজ্যবাদ আর যুদ্ধের প্রতিবাদে। কখনো শোকে মুহ্যমান হয়ে উঠি, কখনো স্তম্ভিত। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে চলে আসা চারুকলার এই মঙ্গলময় শোভাযাত্রায় বিভিন্ন সময় প্রাণ হয়ে ছিল লক্ষ্মীপেঁচা, বর্ণিল মাছ, বাঘ, হাতি, কচ্ছপ, রঙিন পুতুল, সাদা কবুতর, ময়ূর ইত্যাদি। এর সঙ্গে আরও ছিল অজস্র মুখোশ, গরাচিত্র আর রং-বেরঙের হাজারো পাখি। তাই শোভাযাত্রার এই অসংখ্য রঙ্গ, বর্ণ, প্রাণের উচ্ছ্বাস, আবেগ আর আনন্দ-বহিঃপ্রকাশের হিসাব মেলানো বেশ কঠিন।
মঙ্গল শোভাযাত্রার মূল উৎসবের শুরু সেই ১৯৮৫ সালে। যশোরে এস এম সুলতানের ভাবশিষ্য ছাত্ররা সে বছর পয়লা বৈশাখকে প্রাণবন্ত করে তুলতে নানা মুখোশ আর স্থানীয় লোকশিল্পের নানা উপাদান নিয়ে শোভাযাত্রা বের করেন। তাঁদের প্রেরণা থেকেই ঢাকায় চারুকলার শিক্ষার্থী ও তরুণ শিক্ষকেরা ১৯৮৯ সালের দিকে পয়লা বৈশাখ উদ্যাপনের জন্য জোর প্রস্তুতি শুরু করেন। প্রথম শোভাযাত্রার জন্য বানানো হয়েছিল ৫০টি কাগজের মুখোশ, ১০টি বর্ণিল ছোট আকৃতির ঘোড়া ও একটি বিশালাকার হাতি। তাই নিয়ে সকাল আটটায় শোভাযাত্রা বের করেন শিক্ষার্থীরা। শুরুতে ভিড়টা ছিল কম। তবে সুর, ড্রামের বাদ্য আর নতুন এই আয়োজনের রঙ্গ দেখে অসংখ্য মানুষ এসে যোগ দেয় শোভাযাত্রায়। চারুকলায় যখন শোভাযাত্রা শেষ করে সবাই ফেরে হলে; তখন সরু, হালকা-পাতলা দলটি হয়ে গেছে বিশাল জনস্রোত। এভাবেই প্রতিবছর শোভাযাত্রা ধুমধাম করে পালন করা হয়। ১৯৯৪ সালে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির আদলে চারুকলার শিক্ষার্থীরা বানিয়েছিলেন বিশাল এক সাপ। ১৯৯৬ সালে ছিল রং-বেরঙের কাগজে তৈরি ৪০ ফুট লম্বা একটি মাছের প্রতিকৃতি। ২০০১ সালে রমনায় বোমা হামলার পর চারুকলায় ছিল কালো পতাকা। ২০০৩ সালে ইরাক-যুদ্ধের প্রতিবাদে চারুকলায় বানানো হয় ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’, তার হাতের দাঁড়ি-পাল্লার একপাশে পৃথিবী, অন্য পাশে ক্ষেপণাস্ত্র আর টাকা। ২০০৮ সালে ছিল এক বিশাল লক্ষ্মীপেঁচা।
প্রতিবছর চারুকলার মাস্টার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীরা দিনরাত পরিশ্রম করে শোভাযাত্রার বর্ণিল রূপ দান করেন। শোভাযাত্রার নানা জিনিসপত্রের জোগান, শ্রমের জোগান, অর্থের জোগান—সবকিছুরই আয়োজন করেন তাঁরা। পয়লা বৈশাখের বেশ কিছুদিন আগে থেকে নানা ছবি, সরাচিত্র, মুখোশসহ লোকজ বিভিন্ন কারুপণ্যের বিপণন চলে। সেই অর্থ দিয়েই সরঞ্জাম কেনা হয়। পাশাপাশি চারুকলার শিক্ষকেরাও তাঁদের আঁকা ছবি দান করেন। সেগুলোর নিলামে বিক্রি হওয়া প্রাপ্ত অর্থও যায় শোভাযাত্রার ফান্ডে। এভাবেই চৈত্রের শেষ দিনগুলোতে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ চলতে থাকে। নতুনদের সঙ্গে প্রাক্তন শিক্ষার্থীরাও এসে যোগ দেন প্রতিবছর, যাঁরা সেই সূচনালগ্ন থেকেই শোভাযাত্রার অলংকরণে কাজ করে যাচ্ছেন। সাধারণত পয়লা বৈশাখের সকালবেলা রমনা বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠান শেষে চারুকলা থেকে বের হয় শোভাযাত্রা। এর আগে চারুকলার প্রবেশদ্বার থাকে বন্ধ। ভেতরে চলতে থাকে শেষ মুহূর্তের সাজানো-গোছানো। প্রতিবছর শোভাযাত্রা বের হতে সকাল ৯টা-১০টা বেজে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, শহীদ মিনার চত্বর ঘুরে শোভাযাত্রা ফের এসে শেষ হয় চারুকলায়। তার সারাবেলা ধরে অবশিষ্ট চারু-কারুপণ্যের বিপণন চলতে থাকে।
চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রার এই পথ শেষ হওয়ার নয়। মঙ্গলের পথ কি থামবার পথ? এ পথ আজন্ম। শতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী বাঙালি লোকজ কারুপণ্যগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার প্রত্যাশায়েই এই শোভাযাত্রার আয়োজন। আর সেই সঙ্গে শোভাযাত্রা আহ্বান জানায় মঙ্গলের। তাই প্রাণের উচ্ছ্বাসে মেতে উঠি শোভাযাত্রায়।
শিখ্তী সানী
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ০৬, ২০১০
Leave a Reply