যেকোনো ধরনের ক্যান্সারই জীবননাশী ও খুব কষ্টদায়ক। তাই ক্যান্সার থেকে মুক্ত থাকার জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। স্বাস্থ্যসম্মত জীবন যাপন করাই ক্যান্সারমুক্ত থাকার উপায় এবং এ জন্য কিছু নিয়ম মেনে চলার বিকল্প নেই।
সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন
খাদ্যাভ্যাস ক্যান্সারকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। তাই ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণে খাদ্য গ্রহণের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে এবং উচ্চতা অনুযায়ী শরীরের সঠিক ওজন ধরে রাখতে হবে। জীবনের কোনো ধাপেই অতিরিক্ত শীর্ণকায় অথবা স্থূল হওয়া ঠিক নয়। প্রতিদিন যে পরিমাণ ক্যালরি খাবারের সঙ্গে গ্রহণ করা হয়, তার শতকরা ২০ ভাগের বেশি চর্বিজাতীয় হওয়া উচিত নয়।
এক গ্রাম চর্বিজাতীয় খাদ্যে ক্যালরির পরিমাণ ৯। তাই দুই হাজার ক্যালরি গ্রহণকারীর প্রতিদিনের খাবারে চর্বিজাতীয় উপাদান ৪০০ ক্যালরির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। যতটুকু সম্ভব প্রাণিজ চর্বিজাতীয় খাবার খাওয়া বাদ দিতে হবে। যে পরিমাণ চর্বিজাতীয় খাবার আমরা খাই, তার বেশির ভাগই হওয়া দরকার উদ্ভিদজাতীয় ও কম আনহাইড্রোজেনেটেড। চর্বিযুক্ত দুগ্ধজাতীয় খাদ্য, যেমন-ড্রেসিং করা সালাদ, মারজারিন, পনির ইত্যাদির পরিমাণও কম হওয়া দরকার।
দিনে তিন আউন্সের বেশি রেড মিট (গরু, খাসি, ভেড়া ইত্যাদির মাংস) খাওয়া ঠিক নয়। ১৯৯৪ সালে পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, রেড মিট শুধু যে ক্ষতিকর চর্বিযুক্তই তা নয়, বরং এগুলোতে ডায়-অক্সিন নামের এক ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য আছে, যা অনেক ধরনের ক্যান্সারের জন্য দায়ী। মাছ ও পোলট্রিজাতীয় খাবার এসবের তুলনায় অনেক নিরাপদ। প্রচুর তেলে বেশি সময় ধরে ভাজা যেকোনো খাবার খাবেন না। ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, আলু-চিপস্জাতীয় খাবারে অ্যাকরিলামাইড রাসায়নিক পদার্থ বেশি পরিমাণে জমা হয়, যা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। ফাস্টফুডে ব্যবহৃত বেশির ভাগ উপাদানই স্থূলতা তথা ক্যান্সারের আশঙ্কা বাড়ায়। তাই এগুলো যতটুকু সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। লবণজাতীয় খাবার কম খাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে।
খাবার থেকেই শরীরের চাহিদামাফিক সোডিয়াম পাওয়া যায়। তাই কাঁচা লবণ খাওয়া যাবে না এবং রান্নায়ও লবণের পরিমাণ কমাতে হবে। পোড়ানো ও ঝলসানো মাংস খাওয়া একেবারে কমাতে হবে। সম্ভব হলে না খাওয়াই ভালো। প্রক্রিয়াজাত খাবার (জাঙ্ক ফুড) ও শোধিত শর্করা ও চিনিজাতীয় খাদ্যও যতটুকু সম্ভব খাওয়ার তালিকা থেকে বাদ দিন।
কিছু শাকসবজি ও ফলমূল ক্যান্সার-প্রতিরোধী। সালফোরাফেল ও ইনডোলেকারবিনলজাতীয় অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ, যা শরীরের মধ্যস্থ কোষ ধ্বংসকারী মুক্ত রেডিকেলগুলো ধ্বংস করতে সাহায্য করে। মুক্ত রেডিকেল হচ্ছে অক্সিজেনভিত্তিক কতগুলো অণু, যা কোষকলা ধ্বংস করে ক্যান্সার ঘটাতে পারে।
তাই প্রতিদিন ১৩-১৫ আউন্স শাকসবজি ও ফলমূল, ২০-৩০ আউন্স বিভিন্ন রকম শস্যদানা, ডালজাতীয় শস্য (মটরশুঁটি, শিমের বিচি ইত্যাদি), গাছের মূল, লতা ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে খাওয়া দরকার। বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করেছেন, প্রতিদিন পাঁচ ধরনের বিভিন্ন ফল ও শাকসবজি খেলে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝঁুকি অনেকাংশে কমে আসে। সবুজ চা অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ, যা ক্যান্সার কোষের সংখ্যা ও আয়তন কমিয়ে আনতে সহায়তা করে।
দিনে ১০ থেকে ১৫ কাপ ক্যাফিনমুক্ত সবুজ চা, আগে ধূমপানে আসক্ত ছিলেন, এমন লোকদের ফুসফুসের ক্যান্সার প্রতিরোধেও সহায়ক হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তিসির বীজ ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডসমৃদ্ধ, যা ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। সয়াবীজ এবং অন্যান্য সয়াসমৃদ্ধ খাবারে থাকা আইসোফ্লেভনস্ পরিপাকতন্ত্রের, বিশেষ করে কোলন ও মলদ্বারের ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা কমায়।
এ ছাড়া সয়াসমৃদ্ধ খাবার বেশি গ্রহণ করে থাকে এমন মেয়েদের স্তন ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। টমেটোর মধ্যে থাকা লাইকোপেন নামের ক্যান্সারবিরোধী এক ধরনের অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ক্যান্সার প্রতিরোধে খুবই কার্যকর। এটি বিশেষ করে প্রোস্টেট ক্যান্সার প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে। রান্না করা টমেটো বেশি উপকারী। কারণ রান্নার সময় টমেটোর কোষকলা থেকে বেশি পরিমাণে লাইকোপেন বের হয়ে আসে।
ধূমপান
তামাকের মধ্যে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অনেক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে, যার মধ্যে আবার অনেকই ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী। তাই অনেক ক্যান্সারের প্রধানতম ঝুঁকির কারণ হচ্ছে ধূমপান বা তামাক সেবন। মদ্যপান ও ধূমপান একই সঙ্গে যুক্ত হলে তা আরও মারাত্মক হয়ে ওঠে। তাই ধূমপান, মদ্যপান অথবা অন্য যেকোনো ধরনের তামাকজাতীয় দ্রব্য সম্পূর্ণ ত্যাগ করা দরকার।
ক্যান্সার প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে যেসব ভিটামিন
ভিটামিন-সিঃ পেয়ারা, আমলকীসহ বেশির ভাগ টকজাতীয় ফল ও মরিচে ভিটামিন-সি পাওয়া যায়, যা কোষগুলোকে ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা করে এবং রোগ-প্রতিরোধক্ষমতার ওপর ইতিবাচক প্রভাব রাখে।
ক্যালসিয়ামঃ ক্যালসিয়াম কোলন ক্যান্সারের পূর্বলক্ষণ কলোরেকটাল পলিপস্ হওয়ার ঝুঁকি কমায়। কাঁটাসহ ছোট মাছ, কোনো কোনো সামুদ্রিক মাছ, দুধের তৈরি খাবার ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ। তবে প্রাপ্তবয়স্কদের চর্বিমুক্ত দুগ্ধজাত খাবার খাওয়াটা ভালো।
ভিটামিন-ইঃ ভিটামিন-ই বিষক্রিয়া কমিয়ে মুক্ত রেডিকেলগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে তুলতে সহায়তা করে। ভিটামিন-ই আমন্ড বাদাম, চিনাবাদাম, শালগম ও ওলকপির পাতা এবং গমবীজ দিয়ে তৈরি তেলে পাওয়া যায়।
ভিটামিন-ডিঃ শক্তিবর্ধক খাবার, যেমন-দুধে ভিটামিন-ডি রয়েছে। তা ছাড়া সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি ত্বকের সংস্পর্শে এলে ভিটামিন-ডি তৈরি হয়। ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডি একসঙ্গে সেবন করলে কোলন ও প্রোস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে।
ফলিক এসিডঃ কোলোরেকটাল ক্যান্সার ও ধূমপায়ী নারীদের স্তন ক্যান্সারের বিরুদ্ধে এটি কাজ করে।
সেলেনিয়ামঃ শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন উপাদানের একটি হচ্ছে সেলেনিয়াম, যার অল্প পরিমাণ উপস্থিতি কোলন ক্যান্সার ও ফুসফুস ক্যান্সারের জন্য দায়ী কোষকলা ধ্বংস করে। এ উপাদানটি আখরোট ও অন্যান্য বাদামজাতীয় জিনিসের মধ্যে পাওয়া যায়।
যৌনতা ও প্রজননঃ অসৎ সংসর্গ, বহুগামিতা, অপ্রাপ্ত বয়সে গর্ভধারণ, বহু সন্তানের জন্মদান, গর্ভপাত ইত্যাদি কারণে প্রজনন অঙ্গের বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই এগুলো এড়িয়ে চলতে হবে।
শরীরচর্চাঃ অলসতাপূর্ণ জীবন যাপন কোনো কোনো ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে। নিয়মিত শরীরচর্চা রোগ-প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে। গবেষণায় দেখা গেছে, স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে মধ্যম প্রকৃতির ব্যায়ামের পর শরীরে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কোষের সংখ্যা বাড়ে। ব্যায়াম অন্ত্র থেকে কারসিনোজেনসহ (যা ক্যান্সার বিস্তারে সহায়ক) বর্জ্য পদার্থ বের হয়ে যাওয়া পদ্ধতিকে ত্বরান্বিত করে শরীরকে বিষাক্ত পদার্থের উপস্থিতি থেকে রক্ষা করে। সর্বোপরি নিজেকে চিন্তামুক্ত রাখার এবং সতেজ ও সুন্দর থাকার চেষ্টা করা দরকার। এতে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি অনেকটাই কমে আসে।
লেখকঃ ড· জাকিয়া বেগম
দৈনিক প্রথম আলো, ০২ জানুয়ারী ২০০৮
Leave a Reply