ড. মেহতাব খানম দীর্ঘদিন ধরে কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিষয়টি পড়াচ্ছেন। তিনি আপনার বিভিন্ন মানসিক সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন। আপনার সঠিক পরিচয় না দিতে চাইলে অন্য কোনো নাম ব্যবহার করুন। যে সমস্যার কথা আপনি ছাপতে চান না, তা লিখে পাঠাবেন না। খামের ওপর অবশ্যই ছুটির দিনে মনের জানালা কথাটি লিখবেন।
—বি.স.
সমস্যা: আমি বিএম কলেজ থেকে অনার্স ফাইনাল দিয়েছি (উদ্ভিদবিজ্ঞান)। আমি আমার মা-বাবা আর ভবিষ্যৎ স্বামীর কথা ভেবে কখনো কারও ভালোবাসা নিতে পারিনি। এমনকি নিজের ভালো লাগলেও কাউকে কোনো দিন প্রশ্রয় দিইনি। নিজের কাছে সত্ থাকাটা অনেক বড় মনে হতো। কিন্তু এখন আমার বিয়ের কথা হলে কাউকে হ্যাঁ বলতে পারছি না। কারণ যে আমার স্বামী হবে, তার অবশ্যই একটা অতীত জীবন থাকবে। সে কি আমাকে ভালোবাসতে পারবে? যার জন্য সব ভালোবাসা রেখে দিয়েছি। তাকে কি আমি ভালোবাসতে পারব? সমস্যা হলো, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা আমি কিছুতেই ইতিবাচকভাবে নিতে পারছি না। বিয়ে তো করতেই হবে, কিন্তু বিয়ের কথা ভাবলেই আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি।
অভিনন্দা, বরিশাল
পরামর্শ: বুঝতে পারছি, বিয়ের ব্যাপারে তোমার ভয়টা একটু বেশিই কাজ করছে। তবে এ সম্পর্কে ঢোকার আগে প্রত্যেক সচেতন মানুষই কিন্তু ভয় পায়। তবে শুধু ভবিষ্যৎ জীবনসঙ্গীর কথা ভেবে সব ভালোবাসা জমিয়ে রাখার ব্যাপারটা কি খুব বাস্তবসম্মত? যে মানুষটি এখনো তোমার জীবনে আসেইনি, শুধু স্বামী হওয়ার কারণে তুমি তাকে সমস্ত মন উজাড় করে ভালোবাসতে পারবে, তেমন কোনো নিশ্চয়তা আছে কি? কারণ একটি মানুষকে পুরোপুরি নিঃশর্তভাবে ভালোবাসা আসলে সম্ভব নয়। সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশ থেকে আসা দুই জেন্ডারের দুজন মানুষ কেউ কাউকে বিন্দুমাত্র দোষারোপ করবে না, কারও প্রতি কারও কোনো অভিযোগ থাকবে না, সারাক্ষণ সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করবে আর শুধুই ভালোবাসবে, এটি তো আমরা আশা করতে পারি না। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক মূলত আবেগীয় নির্ভরশীলতার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, যদিও অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়গুলোর যথেষ্ট গুরুত্ব থাকে। তবে চিন্তাচেতনা, রুচিবোধ, মূল্যবোধ, ভালো লাগা, মন্দ লাগা—এ বিষয়গুলোতে পরস্পরের বৈশিষ্ট্যে যত বেশি সাদৃশ্য থাকবে, ততই এ সম্পর্ক আনন্দদায়ক ও দৃঢ় হবে। এ ছাড়া দুজনকেই অনেক বেশি প্রচেষ্টা দিতে হয় পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস অর্জন করার জন্য। প্রত্যেক মানুষের অতীতে কিছু ঘটনা থাকতেই পারে। তুমি যেহেতু কোনো প্রেমের সম্পর্কে নিজেকে জড়াওনি, সে জন্য স্বামীর ক্ষেত্রেও তা-ই হবে বলে মনে করছ। কিন্তু যেসব স্বামী বা স্ত্রীর এ ধরনের কোনো অতীত নেই, তারা কি সবাই তাদের জীবনসঙ্গীকে আন্তরিকভাবে ভালোবাসতে পারছে? পারছে না, কারণ আমাদের মন সত্যিই খুব জটিল আর বিচিত্র। তবে এর মধ্যেও আমাদের একে অপরকে বিশ্বাস করতে হয়। অন্য কারও সঙ্গে বিয়ের আগে সম্পর্ক থাকলেও বা বিয়ের পর কারও প্রতি ভালো লাগা তৈরি হলেও দুজনকেই এই পবিত্র বন্ধনের প্রতি অবশ্যই শ্রদ্ধাশীল ও অনুগত থাকতে হবে। সেটি যদি কোনো একজনের পক্ষে একেবারেই সম্ভব না হয়, তাহলে তো জোর করে মনের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে গিয়ে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার অর্থ থাকে না। তোমাকে যদি বিবাহিত জীবন সম্পর্কে আরও কিছু ভীতি তাড়া করে বেড়ায়, তাহলে সেগুলো নিয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিশ্বস্ত ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারো । আর বিয়ে মানেই কিন্তু দুজন মিলে একটি মানুষ হয়ে যাওয়া নয়। দুজনই নিজস্ব সত্তা, পরিচিতি, স্বকীয়তা বজায় রেখে চললেই কিন্তু একটি সুস্থ, বন্ধুত্বপূর্ণ, সুন্দর দাম্পত্য জীবন গড়ে তোলা সম্ভব হয়।
সমস্যা: আমি দশম শ্রেণীতে পড়ি। দশম শ্রেণীর প্রথম দিক থেকে পত্রিকা পড়া শুরু করি। আমাদের গ্রামে কেউ খেলাধুলা, গল্প, আড্ডা করতে চায় না। সবাই সবার জীবনসংগ্রামে ব্যস্ত, বিকেলবেলা খুব খারাপ কাটে আমার। আমি খুব বন্ধু ও আড্ডাপ্রিয়। তাই কাউকে যখন কাছে পাই না, তখন বিকেলে বসে বসে প্রথম আলো পড়ি। আমার মা-বাবা এটা পছন্দ করেন না। আমাকে কারও সঙ্গে মিশতে দেখলে রাগারাগি করেন। আর পত্রিকা তো একদম পছন্দ করেন না। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে বিলের পাড়ে বসে পত্রিকা পড়ি, যাতে কেউ না দেখে। আমার পত্রিকা পড়ার কথা এখন আর কারও অজানা নয়। স্কুলের বন্ধুরা হাসি-ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে। আমার বাবা সেনাবাহিনীতে কর্মরত। সবচেয়ে অবাক হলাম, যেদিন তিনি বললেন, আমি যেন আর বই পড়া ছাড়া পত্রিকা পড়া না দেখি। এরপর কড়া মেজাজের সঙ্গে আরও অনেক কিছু। যেমন—কেবল দশম শ্রেণীতে, এখন থেকে পড়ে পেপার। এই, তুই কি রাজনীতি করবি নাকি? নাকি করিস? তার সঙ্গে মা-ও অনেক কটু কথা বললেন। এখন আমি আর পত্রিকা সংগ্রহ করি না। এ জন্য খুব খারাপ লাগে। কিন্তু পত্রিকা ছাড়া বিকেলগুলো কীভাবে কাটাব? লেখাপড়ায় বেশি মন বসছে না। কেমন যেন পাগল পাগল লাগছে নিজেকে। কোনো কাজ করতে ইচ্ছা করে না। এখন আমি কী করব?
মো. শাকির, মোল্লাহাট, বাগেরহাট
পরামর্শ: তোমার চিঠিটা পড়ে যেমন খুব ভালো লেগেছে, ঠিক তেমনি কষ্ট হয়েছে, তুমি তোমার অত্যন্ত প্রিয় একটি কাজ করতে পারছ না জেনে। তোমার পরিবার ও স্কুলের বন্ধুদের একেবারেই কোনো ধারণা নেই, প্রথম আলো বা অন্য কোনো ভালো পত্রিকা পড়লে আমাদের মন কতটা সমৃদ্ধ হয়। কেবল স্কুলের পড়া কিন্তু আমাদের আত্মার উন্নয়ন ঘটাতে এবং পৃথিবীর, রাষ্ট্রের, সমাজের, প্রাকৃতিক পরিবেশের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে শিক্ষিত করে তুলতে সক্ষম হয় না। কাজেই নিজের পত্রিকা পড়ার অভ্যাসটি তুমি ছেড়ে দিয়ো না এবং এ জন্য নিজেকে কিন্তু মনে মনে প্রশংসিত করবে। বাড়ি থেকে খুব বেশি বাধা এলে তুমি কিছুদিনের জন্য পত্রিকা পড়া বন্ধ রাখতে পারো। তুমি আমাকে জানাওনি প্রথম আলোতে ছাপানো কোন জিনিসগুলো তুমি বেশি করে পড়। শুধু খবর না পড়ে তুমি যদি অন্যান্য বিভাগও মনোযোগ দিয়ে পড়ো, তাহলে অনেক বেশি উপকৃত হবে। তবে নিয়মিত পড়াশোনা করলে তুমি এসএসসিতে একটি ভালো ফলাফল করতে পারবে। আর তোমার মা-বাবা যদি একেবারেই না বোঝেন, তাহলে তাঁদের খুশি রাখার জন্য কিছুদিন অন্তত লেখাপড়ায় বেশি মনোযোগ দাও এবং নিজের প্রতি অনেক সম্মান, বিশ্বাস নিয়ে বর্তমান সময়টি পার করার চেষ্টা করো। অনেক অনেক শুভকামনা রইল তোমার জন্য।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ০৩, ২০১০
Leave a Reply