টিপ, কপালে একটুখানি রঙের ছটা। বাঙালি নারীর সাজের অনুষঙ্গ। কখনো উৎসবে, কখনো মনের আনন্দ প্রকাশে, কখনো বা চাহনিতে টিপ আভিজাত্য ফুটিয়ে তোলে। টিপ পরার ক্ষেত্রে কাজ করে একেকজনের একেক দৃষ্টিভঙ্গি। মনের ভেতর যে ভাবনার প্রতিফলনই কাজ করুক না কেন, সাধারণ একটি টিপেই চেহারায় চলে আসে অসাধারণ লুক। এই একটুখানি রঙিন আভা সাজে নিয়ে আসে পরিপূর্ণতা।
বাঙালি সাজে টিপ
এশিয়ার দু-তিনটি দেশে টিপের ব্যবহার বেশি হয়। এর একটি কারণ বোধহয় আমাদের চেহারা এবং পোশাকের সঙ্গে এর সামঞ্জস্যতা বেশি।
নৃত্যশিল্পী মুনমুন আহমেদ বলেন, ‘টিপের গুরুত্ব অনেক। টিপ একটি মেয়ের সাজে পরিপূর্ণতা আনে। দুই ভুরুর মধ্যে যখন টিপ পরা হয়, মনে হয় সব সাজই হয়ে গেল।’
অভিনয়শিল্পী রোজী সিদ্দিকীর খুব প্রিয় হলো টিপ। সাধারণত বড় টিপই পরতে পছন্দ করেন তিনি। ‘যখনই শাড়ি পরি, যত্ন নিয়ে টিপ আঁকি, সব সময় চেষ্টা করি একটু ভিন্নধর্মী কিছু করার। এটি আমার শখও’ জানান তিনি। ব্যান্ডদল লালন-এর কণ্ঠশিল্পী সুমি। তাঁর সাজের একটি বিশেষত্ব, তিনি সব সময় বড় টিপ পরেন। সব পোশাকের সঙ্গেই তিনি টিপ পরেন। ‘বাঙালি নারীর যে মাধুর্য, তা অনেকটা টিপের মাধ্যমেই ফুটিয়ে তোলা যায়।’ বলেন তিনি।
টিপের জয়গান এখন বাঙালিদের সীমানা ছাড়িয়ে অবাঙালিদের হূদয়ে। বৈশাখ, বসন্ত, নবান্ন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমাদের সঙ্গে তারাও শরিক হয় রঙিন টিপের সাজে । আর কিছুতে হোক না হোক কপালে ছোট একটু রঙের ছোঁয়া এ দেশের সাজটাই তুলে ধরে অন্যদের কাছে পুরোপুরি বাঙালিয়ানায়। মাধুর্যতা প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে ঐতিহ্যগতভাবে আমাদের সংস্কৃতও ফুটে ওঠে কপালের এ নকশার মাধ্যমে।
ফ্যাশনে টিপ
টিপের জনপ্রিয়তাই তৈরি করেছে এর রকমারি। যুগ যুগ ধরে চলে আসা টিপের রূপ বদলেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে।
সাধারণ গোল টিপ তো আছেই। এর ওপরে লাগানো হচ্ছে পাথর বা ছোট্ট ঝুমকা। কপালে একটু ঝিলিকের জন্য লাগিয়ে ফেলুন পাথরের টিপ। হতে পারে এটি একরঙা অথবা কয়েকটি রঙের মিশ্রণে।
নৃত্যশিল্পী মুনমুন আহমেদের পছন্দের তালিকায় আছে আলপনা টিপ। যে শাড়িটি পরেন, তারই কিছুটা নকশা তিনি তুলে ধরেন দুই ভুরুর মধ্যে। ‘আঁকতে আঁকতে এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি। খুব তাড়াতাড়ি এঁকে ফেলতে পারি এখন।’ বলেন তিনি।
খুব সুন্দর করে আঁকার এ দক্ষতাই আলপনা টিপকে দিয়েছে ভিন্নধর্মী প্রাধান্য। কুমকুমের টিপের ইতিহাস অনেক অনেক আগের। রাজা-রানিদের কপালে শোভা বর্ধন করে এখন রয়েছে আমাদের সাজের তালিকায়।
ফ্যাশনসচেতন মানুষ অবশ্য দু-তিন ধরনের মিশ্রণে টিপ পরেন। আলপনা টিপের সঙ্গে পাথর মিলিয়ে অথবা সাধারণ টিপের আশপাশ দিয়েও এঁকে নিচ্ছেন প্রয়োজনমতো। এছাড়াও সাধারণ বড় টিপের নিচে ছোট একটি, পরপর নিচে বসানো ছোট পাথরের অথবা সাধারণ গোল টিপ পরে চারপাশ দিয়ে লাইন টেনে নিচ্ছেন। মোট কথা পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে, রুচির সাথে তাল মিলিয়ে একটু ভিন্নভাবে লাগিয়েই ফেলুন না টিপটি। খারাপ বই ভালোই লাগবে।
চেহারার কাটে টিপের ছাঁট
রূপবিশেষজ্ঞ অঞ্জলি মোস্তফা জানান চেহারার কাটের সঙ্গে মানানসই ছাঁটের টিপের কথা।
গোল চেহারার অধিকারীরা লম্বা টিপ পরলে ভালো দেখাবে।
যাদের চেহারার ধাঁচ লম্বাটে, গোল টিপই হওয়া উচিত তাদের প্রথম পছন্দ।
পানপাতা ও চারকোনা কাঠের চেহারার সঙ্গে লম্বা টিপ মানানসই হবে।
তবে মাঝেমধ্যে ছাঁটের কিছুটা অদলবদল একটু ভিন্নধর্মী চাহনি পরিবর্তনে মন্দ লাগবে না।
সব বয়সেই পরা যায়
‘আয় আয় চাঁদমামা টিপ দিয়ে যা, চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা…’। গানের তালে ছোট্ট দুটি হাত বাড়িয়ে প্রাণপণ চেষ্টা। চাঁদটাকে কোনোভাবে যদি টিপ হিসেবে কপালে লাগানো যেত। ছোটবেলা থেকেই ছেলে হোক মেয়ে হোক প্রায় সবাই বোধহয় মায়ের কণ্ঠে এ গান শুনেছি। সেখান থেকেই হয়তো টিপের প্রতি এত ভালোবাসা বাঙালি নারীর। টিপের প্রতি এ দুর্বলতার কথা জানালেন সুমি। সপ্তম শ্রেণী থেকেই তিনি টিপ পরা শুরু করেছেন। ‘আমার ঘরের আয়নায় টিপের আঠার অসংখ্য দাগ। ব্যাগে আর কিছু থাক বা না থাক, টিপের পাতা থাকবেই।’ হেসে জানান তিনি। সুমির মন খারাপ, ভালো হওয়াটাও অনেক সময় নির্ভর করে এ টিপের মধ্য দিয়েও। ‘আমার মন খারাপ থাকলে টিপ পরলেই ভালো হয়ে যায়। টিপ না পরতে পারলে অনেক সময় মন খারাপও হয়ে যায়।’
রোজী সিদ্দিকী বলেন, ‘এইচএসসি পরীক্ষা যখন দিই, তখন থেকেই শাড়ি পরা শুরু। এর সঙ্গে শুরু হয় টিপ পরাও।’ ‘নাচ শুরু করার সঙ্গেই টিপ পরা শুরু। যখন টিপ পরা শুরু করি, মা বললেন, এবার তো তাহলে আমার টিপ পরা ছেড়ে দিতে হয়।’ হেসে জানান মুনমুন আহমেদ।
সাজের এই ছোট জিনিসটা বয়সের ক্ষেত্রে মানে না কোন নির্দিষ্ট সীমারেখা । এর শুরু ও শেষ দুটোই নির্ভর করে নারীর রুচি ভালো লাগার ওপর। রং পরিবর্তন এবং নকশার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চেহারায় খেলে যায় রহস্যময়তা।
পোশাক ও টিপ
টিপ সবচেয়ে বেশি মানানসই দেশীয় পোশাকের সঙ্গে। জানান ফেমিনা বিউটি পারলারের স্বত্বাধিকারী অঞ্জলি মোস্তফা। তবে পশ্চিমা পোশাকের সঙ্গে মানিয়ে পরতে পারলে খারাপও লাগবে না।
মুনমুন আহমেদ বলেন, ‘টিপ ছাড়া শাড়ির সাজ পরিপূর্ণতা পায় না। জর্জেট কিংবা শিফন পরলে টিপ পরি না। কিন্তু সুতি ও সিল্ক শাড়ির সঙ্গে বেশির ভাগ সময় আমি টিপ পরি। রং মিলিয়ে অথবা একটু গাঢ় লাল রঙের।’
দাওয়াতের পোশাকের সঙ্গেই অরনামেন্টাল টিপ বেশি মানানসই। অন্যদিকে সারা দিনের ব্যস্ততায় সাধারণ টিপ ব্যবহার করা উচিত।
কিছু কথা
অঞ্জলি মোস্তফা জানান, কপালের দিকটি খেয়াল করেও আমাদের টিপ পরা উচিত। যাদের কপাল আকারে ছোট, তাদের জন্য ছোট টিপ মানানসই। যাদের কপাল বড়, তারা বড় টিপ পরলেও সমস্যা নেই। বড় দুল পরলে সে ক্ষেত্রে ছোট আকারের টিপ পরলে ভালো লাগবে। এ ছাড়া টিপের আঠার কারণে অনেক সময় র্যাশ দেখা দিতে পারে। টিপ খোলার পর বেবি অয়েল দিয়ে আঠা মুছে ফেললেই এ ঝামেলার অবসান হবে।
রয়া মুনতাসীর
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ৩০, ২০১০
Leave a Reply