হাইলাইটস
- ডালহৌসি নামটা শুনলে কেজো বাঙালির কানে ভেসে ওঠে তারস্বরে হর্ন, লোকজনের চেঁচামিচি, হকারদের হাঁকডাক, দোকানির সঙ্গে দামাদামির চিৎকার, সিগন্যাল ভেঙে রাস্তা পারাপার, বাসের রেসারিসি, মাঝে মাঝে পুলিসের সাইরেনের চিল চিৎকার।
- সেখানে সবাই ব্যস্ত। এতটুকু দম ফেলার সময় কারও নেই।
- সকাল ১০ থেকে রাত প্রায় ৮টা পর্যন্ত চিত্রটা একই রকম। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কোলাহল কমতে থাকে।
কেজো বাঙালিকে বক দেখিয়ে ডালহৌসি হল ভ্রমণ প্রিয় বাঙালির শান্তির আশ্রয়। তবে ইট কাঠ পাথরের কলকাতা নয় এই ডালহৌসি থাকে সেই হিমাচল প্রদেশে। ১০টা-৫টা ডিউটি নয়, সেখানে শুধুই অবকাশ আর অশেষ শান্তি। একটা সময় ছিল যখন ব্রিটিশদের তৈরি এই পাহাড়ি শহর ছিল উচ্চবিত্তদের অবকাশ যাপনের স্থান। মধ্যবিত্তরা খরচ কুলোতে পারতেন না। ডালহৌসির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখে অনেকেই তাকে ভারতের সুইৎজারল্যান্ড বলে আখ্যা দেন। এখানকার ঘরবাড়ি ভিক্টোরিয়ান যুগের নকশায় তৈরি, পাহাড় জঙ্গলের মাঝে এই বাড়িগুলি যেন সদাই রহস্যে মোড়া। সেই রহস্যের টানেই সেখানে হাজির হন ভ্রমণপ্রেমীরা।
অসাধারণ প্রাকৃতিক শোভার কারণেই প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক ডালহৌসিতে ভিড় জমান। ভিড় বাড়ে প্রধানত গ্রীষ্মকালে। হিমাচলের ছোট্টো শহর ডালহৌসি লোকালয় থেকে অনেকটাই দূরে অবস্থিত। সেকারণে এখানে শান্তি সদা বিরাজমান। পরিবেশ দূষণ প্রায় শূন্য। ভিক্টোরিয়ান স্কটিশ ডিজাইনের বাংলো এবং চার্চ পর্যটকদের বাধ্য করে কটা দিন ডালহৌসিতে কাটাতে। দুটি বাড়ির মধ্যে অনেকটা ফাঁকা অংশ। ফলে একান্তে ব্যক্তিগত মুহূর্ত কাটানোর জন্য আদর্শ। প্রাচীন হিন্দু সংস্কৃতি, মন্দির এবং হস্তশিল্প-কলার এক অসাধারণ সমাহার এই ডালহৌসি।
তাই নিরিবিলি ডালহৌসি ঘুরে বেড়াতে গেলে একটু সময় নিয়ে যান। ধীরে ধীরে স্থানীয় এলাকা ঘুরে আসুন। অবকাশ কাটান কফির কাপে চুমুক দিয়ে।
খাজ্জিয়ার
ডালহৌসির সবচেয়ে সুন্দর জায়গাটির নাম খাজ্জিয়ার। আসলে ঠিক ডালহৌসিকে নয় এই খাজ্জিয়ারকেই বলা হয় ভারতের সুইৎজারল্যান্ড। এখানে বেড়াতে নয় অবকাশ কাটাতে যান পর্যটকরা। বেশিরভাগ পর্যটক এখানে এক বা দুই দিনের জন্য বেড়াতে যান। কিন্তু বিশ্বাস করুন সাতটা দিন যদি এখানকার শান্ত-নিস্তব্ধ পরিবেশে থাকতে পারেন তাহলে মেডিটেশনের কাজটা অনেকটাই সেরে নেওয়া যায়। প্রকৃতির অপূর্ব রূপ, নিঃস্তব্ধতা এবং একান্ত অবকাশ আপনার মনকে শান্ত করবে। যদি লম্বা অবকাশের লক্ষ্যে খাজ্জিয়ারে যান তাহলে রোজ সকাল বা বিকেলে এক এক করে এখানকার বিশেষ জায়গাগুলি ঘুরে আসতে পারেন।
মাঝে মধ্যে বেড়াতে যেতে পারেন খাজ্জিয়ার হ্রদে। এর আকারটি অনেকটা সসেজের মতো। এলাকার লোকজনও মাঝে মধ্যে এখানে বেড়াতে যান। স্নিগ্ধ ঠান্ডা আবহাওয়ায় বসে সঙ্গীর সঙ্গে গল্প করতে বা হালকা গান শুনতে খুব ভালো লাগবে। দর্শন করে আসতে পারেন খাজ্জি নাগ মন্দিরেও। পুজো দিন বা না দিন পাহাড়িয়া এলাকার প্রায় আটশো বছরের পুরোনো মন্দিরের পরিবেশ ভালোই লাগবে। শিব ঠাকুররে মন্দিরে দেওয়ালজুড়ে রামায়ণ-মহাভারতের গল্পের কাঠের কাজের নকশা মুগ্ধ করতে পারে শিল্পীমনকে। ইচ্ছে হলে ট্রেকিং-এর যেতে পারেন। স্থানীয়দের জিজ্ঞাসা করলেই ব্যবস্থা হয়ে যাবে।পায়ে হেঁটে বা গাড়িতে চড়ে গ্রাম ঘুরে বেড়ান। পাহাড়িয়া জীবনযাত্রার অভিজ্ঞতাই আলাদা। এখান থেকে কৈলাস পর্বতকে স্পষ্ট দেখা যায়। তুষারপাতের সময় খাজ্জিয়ারের সৌন্দর্য দেখে সুইৎজারল্যান্ডও ঈর্ষা করবে।
খাজ্জিয়ার থেকে কাঙড়া বিমানবন্দরের দূরত্ব ১২৬ কিলোমিটার, পাঠানকোট রেলস্টেশন প্রায় ৯৪ কিলোমিটার। খাজ্জিয়ার এবং ডালহৌসির মধ্যে দূরত্ব মাত্র ১৬ কিলোমিটার।
পঞ্চপুলা
ডালহৌসির আরেকটি অপূর্ব সুন্দর স্থানের নাম পঞ্চপুলা। এখানে বয়ে গেছে এক দয়াকুণ্ড নামে প্রাচীন পাহাড়ি নদী। এই নদীর ধারেই পর্যকরা ভিড় জমান। এখানে আছে বিপ্লবী সর্দার অজিত সিং-এর সমাধি। আর এখানকার স্থানীয় খাবার একবার যে খাবে সে সহজে ভুলবে না।
সচ পাস
চম্বা জেলার সচ শহরে। বিশ্বের অন্তম ভয়ঙ্কর রাস্তা কিলার থেকে সচ পাসের দূরত্ব মাত্র ১৫ কিলোমিটার। রাস্তাটি চলে গিয়েছে পাঙ্গি আদিবাসীর গ্রামের ভিতর দিয়ে। সচ ভ্যালি পায়ে হেঁটে দেখতে হয়। না হলে ঘোরার আনন্দ ঠিক জমে না। ঘন আরণ্য, বরফের মেঝে, সবুজ গাছ, আর নিঃশব্দ পরিবেশ হরর ফিল্ম বা ডিটেক্টিভ গল্পকের স্মৃতিকে উস্কে দেয়। এই রাস্তায় দিয়ে বাইকে করে যেতেও দারুণ লাগে।
ডাইনকুণ্ড শৃঙ্গ
কুয়াশাচ্ছন্ন নিস্তব্ধ জঙ্গলের ধারে পাখির গান শুনতে চান? তাহলি ডাইনকুণ্ড শৃঙ্গে ঘুরে আসুন। সেখানে সারাদিন পাখিদের যুগলবন্দি শোনা যায়। ২৭৫৫ মিটার উঁচুর এই শৃঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটানো যায়। গানের সঙ্গে ফ্রিতে মিলবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এখানকার ভারতীয় বায়ুসেনার ঘাঁটি এবং ফোলানি দেবীর মন্দির বেশ জনপ্রিয়।
চামেরা হ্রদ
ডালহৌসি বেড়াতে গেলে চামেরা হ্রদটি ঘুরে দেখতেই হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭৬৩ মিটার উঁচু স্থানে অবস্থিত এই হ্রদের ধারেও পর্যটকরা ভিড় জমান। ডালহৌসি থেকে এই হ্রদের দূরত্ব মাত্র ৩০ কিলোমিটার। ইরাবতি নদীর উপর চামেরা বাঁধের সৌন্দর্য্যও অসাধারণ। একানে ওয়াটার স্পোর্টে মেতে ওঠেন অ্যাডভেঞ্চাররা।
এখান থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখতে অসাধারণ।
সাতধারা জলপ্রপাত
সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২০৩৫ মিটার উঁচুতে অবস্থিত সাতধারা জলপ্রপাতের সৌন্দর্য ভাষার প্রকাশ করা যায় না। সাতটি নদীর মিলনে তৈরি হয়েছে এই জলপ্রপাতটি। সেকারণেই এর নাম সাতধারা। জলপ্রপাতের কারণে এলাকার আবহাওয়া একেবারে অন্যরকম। লোকের বিশ্বাস এই জলপ্রপাতের জল রোগনির্মূল করতে সক্ষম, শরীরে ব্যথা বেদনা দূর করে অনায়াসে। পঞ্চপুলা থেকে পায়ে হেঁটেই সাতধারা যাওয়া যায়। এই এলাকায় লোকে জমিয়ে পিকনিক করে।
সেন্ট প্যাট্রিক চার্চ
ডালহৌসি শহর থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ১০৪ বছর পুরোনো সেন্ট প্যাট্রিক চার্চ। চার্চ বাড়ির ভিক্টোরিয়ান নকশা অপূর্ব সুন্দর। সঙ্গে রয়েছে অপূর্ব সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত চার্চে প্রবেশের অনুমতি থাকে।
লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দির
চম্বা জেলায় রয়েছে এক প্রাচীন লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দির। মন্দির এবং সংলগ্ন একারার স্থাপত্য শিল্প দেখলে মাথা ঘুরে যাবে। ডালহৌসিতে বেড়াতে গিয়ে অন্তত কয়েক ঘণ্টা এই মন্দিরে কাটালে ভালো লাগবে।
ম্যাল রোড
আমাদের দার্জিলিঙের মতো ডালহৌসিতেও রয়েছে ম্যাল রোড। শপিং করার জন্য দারুণ জায়গা এটি। কাশ্মীরী শাল, নানা ধরনের পুতুল, হাতে তৈরি ঘর সাজানোর জিনিস যেমন পাওয়া যায় তেমনই রয়েছে হরেক রকমের রেস্তোরাঁ, বার, ক্লাব, ব্যাঙ্ক ইত্যাদি। সস্তা থেকে দামি সব ধরনের জিনিস মেলে এখানে। যাঁরা কফি খেতে ভালোবাসেন তাঁরা এখানে ভালো সময় কাটাতে পারবেন। ম্যাল রোডে আছে অনেক ক্যাফে। সেখানে মেলে নানা ধরনের কফি। প্রকৃতির কোলে বসে সেই কফি খাওয়ার মজাই আলাদা।
তিব্বতি বাজার
ম্যাল রোডের পর গান্ধি চৌকের তিব্বতি বাজার ঘুরে আসা উচিত একদম শেষ দিনে। আর তিব্বতি বাজার জন্য কেনাকাটির স্বর্গ। হাতের কাজের জিনিস, পশমের গরম পোশাক, কার্পেট, গয়না এবং চম্বার স্পেশাল পায়ের চটি এখানে মিলবে নানা দামে। দোকানগুলি চালান মূলত তিব্বতিরা। সেকারণেই এই বাজারের নাম তিব্বতি বাজার।
ভ্যাক্সিনের দুটি ডোজ নেওয়া থাকলে দেশের অনেক জায়গাতেই বেড়াতে যাওয়ার অনুমতি মিলছে। তাই ভ্যাক্সিনের ডোজ শেষ তবে বেড়াতে যান। বেড়াতে গিয়েও মাস্ক, স্যানিটাইজার, হাত ধোয়া, দূরত্ব বজায় রাখার মতো সাবধানতাও অবলম্বন করতে হবে।
Lifestyle News in Bengali, লাইফস্টাইল খবর, Health Tips, Fashion Trends and Tips in Bangla
2021-07-28 18:23:29
Source link
Leave a Reply