জীবনের ছাব্বিশটা বছর যে রোগের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন এ বার হয়তো নিজের সদ্যোজাত সন্তানের সাহায্যে তার থেকে বাকি জীবনের মতো নিষ্কৃতি পেতে চলেছেন পিঙ্কি বর্মন! কারণ, এই প্রথম থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত কোনও মাকে তাঁর সন্তানের নাড়ির রক্তের স্টেম সেল প্রয়োগ করে সুস্থ করে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। চিকিৎসকেরা তেমনই দাবি করেছেন।
থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত নদীয়ার মাটিয়াড়া গ্রামের পিঙ্কি। নিয়ম করে রক্ত নিয়ে তবেই তাঁর বেঁচে থাকা। বিয়ে হয়েছিল অবিনাশ বর্মণের সঙ্গে। অবিনাশ সম্পূর্ণ সুস্থ। ফলে তাঁদের ছেলেও থ্যালাসেমিয়া-আক্রান্ত নয়, থ্যালাসেমিয়ার বাহক মাত্র। বুধবার হাওড়ার সাঁতরাগাছির এক নার্সিংহোমে সেই শিশুর জেন্মর পরেই আম্বিলিক্যাল কর্ডের মধ্যে থাকা তার রক্তের থেকে স্টেম সেল সংগ্রহ করেন চিকিৎসকেরা। সেই সংগৃহীত স্টেম সেল দেওয়া হচ্ছে মা পিঙ্কির দেহে। চিকিৎসার ভাষায় যাকে বলা হয়, ‘রিভার্স হ্যাপলো আইডেন্টিক্যাল স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্টেশন।’ তাতেই থ্যালাসেমিয়া থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি পেতে পারেন পিঙ্কি। তবে চূড়ান্ত ফলাফলের জন্য এক বছর অপেক্ষা করতে হবে। জোকার কাছে একটি কর্ড ব্লাড ব্যাঙ্কে ওই স্টেম সেল প্রসেস করা হচ্ছে।
চিকিৎসকদের দাবি, পিঙ্কির ঘটনাটি সকলের থেকে আলাদা এবং অনন্য। এর আগে পৃথিবীতে মাত্র তিনটি ঘটনায় সন্তানের স্টেম সেল তার রোগাক্রান্ত মায়ের দেহে প্রয়োগ করা হয়েছিল। কিন্তু তার কোনওটিই থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে হয়নি এবং কোনওটিতেই কর্ড ব্লাড স্টেম সেল ব্যবহৃত হয়নি। ওই তিনটি ঘটনার ক্ষেত্রে মায়েরা যথাক্রমে লিউকেমিয়া, মাল্টিপল মায়ালোমা এবং মায়ালো ডিসপ্লাস্টিক ডিসর্ডার সিনেড্রামে ভুগছিলেন। এবং মায়েদের দেহে সন্তানের অিস্থমজ্জা থেকে নেওয়া স্টেম সেল দেওয়া হয়েছিল।
পিঙ্কির এই গোটা চিকিৎসা প্রক্রিয়ার সঙ্গে জিড়ত ছিলেন চিকিৎসক প্রশান্ত চৌধুরী এবং আশিস মুখোপাধ্যায়। প্রশান্তবাবু বলেন, “গর্ভবতী অবস্থায় পিঙ্কির হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক রাখতে সাত থেকে দশ দিন পর পর বিশেষ প্রক্রিয়ায় রক্তের প্যাকসেল দেওয়া হত। সময়ের আগে অপরিণত শিশুর জন্ম হওয়া বা গর্ভপাত হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি ছিল তাই আমাদের অসম্ভব সতর্ক থাকতে হয়েছিল।” আর চিকিৎসক আশিস মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “যেহেতু পিঙ্কির সুস্থ ভাই বা বোন নেই তাই পিঙ্কিকে থ্যালাসেমিয়া মুক্ত করতে আমরা তাঁদের অস্থিমজ্জা থেকে স্টেম সেল তৈরি করে প্রয়োগ করতে পারিনি। পিঙ্কি সন্তান ধারণের ইচ্ছা জানানোর পরে আমরা তখন সেই সন্তানের মাধ্যমে তাঁকে সুস্থ করার চ্যালেঞ্জটা নিই।”
নীলরতনে সফল স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্টেশন
ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত এক রোগীর দেহে স্টেম সেল প্রতিস্থাপন করেছেন নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকেরা। এর ফলে আগামী পাঁচ থেকে সাত বছর ওই রোগী একেবারে সুস্থ হয়ে বাঁচতে পারবেন বলে চিকিৎসকদের দাবি। রক্তের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিলেন বর্ধমানের ভাতারের বাসিন্দা, ৩৭ বছরের বেলা সামন্ত। নীলরতনের হেমাটোলজি বিভাগের চিকিৎসকেরা বেলাদেবীর দেহে ‘অটোলগাস পেরিফেরাল ব্লাড স্টেম সেল ট্রান্সপ্লােন্টশন’-এর সিদ্ধান্ত নেন। বিভাগীয় প্রধান মলয় ঘোষের কথায়, “প্রথমে চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীর ক্যানসার নিয়ন্ত্রণ করেছি। তার পরে তাঁর রক্ত থেকেই স্টেম সেল সংগ্রহ করেছি। তার পরে খুব হাই ডোজে কেমোথেরাপি দিয়ে রোগীর দেহের সমস্ত রক্ত উৎপাদনকারী কোষকে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে এবং ওই সংগৃহীত স্টেম সেল তাঁর দেহে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওই কোষগুলিই এ বার বিভাজিত হয়ে শরীরে নতুন রক্ত কোষ তৈরি করবে।”
পারিজাত বেন্দ্যাপাধ্যায়, কলকাতা
সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা, ফেব্রুয়ারী ১৯, ২০০৯
Leave a Reply