টাইপ-২ ডায়াবেটিসের রোগ-ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে নতুন করে চিন্তাভাবনা করার একটি কারণ ঘটেছে। সাম্প্রতিক তিনটি গবেষণা থেকে বেরিয়ে এসেছে যে কেবল রক্তের শর্করা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করলেই উচ্চ ঝুঁকিসম্পন্ন লোকের হৃদরোগের ঝুঁকি এড়ানো যায় না। সম্ভবত তাদের উচ্চ রক্তচাপ থাকলে এবং তারা স্থূল থাকলে ব্যাপারটা অসম্ভব হয়ে পড়ে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, রক্তের সুগার যেমন নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন, তেমনি হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধে রক্তের গ্লুকোজ মানের লক্ষ্য অর্জনের চেয়ে রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল মানের ঈপ্সিত লক্ষ্য অর্জন হয়তো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যাদের ডায়াবেটিস সম্প্রতি চিহ্নিত হয়েছে, ইতিমধ্যে উচ্চ ঝুঁকিমানে পৌঁছায়নি, তাঁদের ক্ষেত্রে রক্তের সুগারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাসে অবশ্যকার্যকর।
টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশের ক্ষেত্রে মৃত্যু ঘটতে পারে হৃদরোগ ও রক্তবাহ সমস্যার কারণে। দীর্ঘদিন থেকে ধারণা, রক্তে বিগত দুই-তিন মাসে গড় রক্ত শর্করা মান-‘এআইসি মাত্রা’ রোগীদের মধ্যে ৬ শতাংশ পর্যন্ত নামিয়ে রাখলে (নন-ডায়াবেটিকদের জন্য এটি সীমা ছুঁই ছুঁই মান) অনেক হৃদরোগসংক্রান্ত জটিলতা কমানো বা এড়ানো সম্ভব। সাম্প্রতিক চিকিৎসা গাইড-লাইন হলো টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের এআইসি থাকা উচিত ৭ শতাংশ বা এর নিচে। টাইপ-২ ডায়াবেটিস রয়েছে এমন ২৩ হাজার লোকের ওপর সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো নির্ণয় করার চেষ্টা করেছে, মুখে খাওয়ার ওষুধ বা ইনসুলিন প্রয়োগ করে এআইসির মান ৬ শতাংশে নামিয়ে আনলে হৃদরোগ, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ এবং এতে মৃত্যুর মতো হৃদরোগ ও রক্তবাহ রোগ কতটুকু হ্রাস করা সম্ভব। যেসব রোগীর ওপর গবেষণা করা হয়েছে তাঁদের বয়স ষাটের কোঠায়। কয়েক বছর ধরে ডায়াবেটিস রয়েছে এআইসি মান ৭ শতাংশের ওপরে। এঁদের এক-তৃতীয়াংশের ইতিমধ্যে হৃদরোগ বা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে এবং এঁদের মধ্যে অনেকের উচ্চ রক্তচাপ থাকাতে, উঁচুমান কোলেস্টেরল থাকাতে, অনেকে ধূমপায়ী বা স্থূল হওয়াতে হৃদরোগের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছেন।
রোগীদের দুই ভাগে ভাগ করা হলোঃ এক দলকে দেওয়া হলো কঠোর চিকিৎসা, লক্ষ্য ছিল এআইসি মানকে ৬ শতাংশ পর্যন্ত নামিয়ে আনা; অন্য যে কন্ট্রোল গ্রুপ, এঁরা পেলেন প্রচলিত চিকিৎসা। এসব রোগীর অনুসরণ করা হলো পাঁচ বছর। তবে গবেষণা দলের একটি, অর্থাৎ আমেরিকার ন্যাশনাল হার্ট, লাং অ্যান্ড ব্লাড ইনস্টিটিউট সাড়ে তিন বছর পর কঠোর চিকিৎসাটি সরিয়ে নিল। কারণ দেখা গেল, এই গ্রুপে কন্ট্রোল গ্রুপের তুলনায় মৃত্যুঝুঁকি বেড়েছিল ২৩ শতাংশ।
তিনটি গবেষণা দলের গবেষকেরা ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের শুরুর দিকে আমেরিকান ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশনের ৬৮তম বার্ষিক বৈজ্ঞানিক সেশনে উপস্থাপন করেন।
তবে এই গবেষণাগুলোর ফলাফল থেকে এমন ধারণা করা যাবে না যে রক্তের সুগার-মানের কঠোর নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা কম, এই সতর্কবাণীটি গবেষকেরা করেছেন। যদিও উচ্চ ঝুঁকিসম্পন্ন ডায়াবেটিকদের মধ্যে কেবল রক্তের সুগারের কঠোর নিয়ন্ত্রণে হৃদরোগ জটিলতা এড়ানো যায় না, তবে স্বাভাবিক ও স্বাস্থ্যকর রক্ত সুগার-মান বজায় রাখা মাইক্রোভাসকুলার জটিলতা-যেমন চোখ, কিডনি ও স্মায়ুর ক্ষতি এড়াতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি গবেষণা পাওয়া গেছে, যাদের রক্তের সুগার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল, তাদের কিডনি রোগের ঝুঁকি কমেছে ২১ শতাংশ।
এসব গবেষণা থেকে দেখা গেল, সব সমস্যা একটি সমাধানে হয় না, বলেন বিশেষজ্ঞরা। বোস্টনে জসলিন ডায়াবেটিক সেন্টারের মেডিকেল ডিরেক্টর মার্টিন এব্রামসন বলেন, চিকিৎসার লক্ষ্য হওয়া উচিত ব্যক্তিবিশেষের চাহিদা অনুযায়ী। বিবেচনা করতে হবে রোগীকে আর কী কী রোগ আছে তার, তাদের প্রত্যাশিত গড় আয়ু কত-এমন সব বিষয়।
অন্য কথায় এভাবে বলা যায়, ডায়াবেটিস টাইপ-২ সব রোগীর এআইসি, রক্তচাপ ও কোলেস্টেরলের ঈপ্সিত মানে পৌঁছানোর চেষ্টা করা উচিত। তবে ব্যক্তিবিশেষে গুরুত্ব বিবেচনা হবে ভিন্ন ভিন্ন। যাদের ডায়াবেটিস সাম্প্রতিককালে চিহ্নিত হয়েছে এবং যাদের হৃদরোগের অন্য ঝুঁকি নেই, তাদের জন্য এআইসি মানের কঠোর শাসন প্রয়োজন, বলেন এব্রামসন। তবে বয়স্ক লোক, যাদের ইতিমধ্যে হৃদরোগের সমস্যা রয়েছে, তারা রক্তচাপ ও রক্তের কোলেস্টেরল-মানের নিয়ন্ত্রণে বেশি সুফল লাভ করবেন। সব ধরনের রোগী প্রতিদিন এসপিরিন গ্রহণ করলে ভালো। ধূমপান বর্জন করা উচিত, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া ও ব্যায়াম করা উচিত। এতে ঐকমত্য রয়েছে সবার।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরীর কলম থেকে
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস
বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ১৮, ২০০৯
Leave a Reply