ছেলেবেলায় দু-চারটা চড়, উত্তমমধ্যম খাননি এমন মানুষ মেলা ভার। অনেক অভিভাবকই মনে করেন, শাসন মানেই হলো মারা। তা না হলে যে সন্তানকে সঠিকভাবে মানুষ করা যাবে না। এমন ধারণা এখনো অভিভাবকদের মধ্যে রয়েছে। এ ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সন্তানকে সঠিকভাবে গড়ে তুলতে এমন মানসিকতা থাকা খুবই ক্ষতিকর। শাসন অবশ্যই করতে হবে। তবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে নয়। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে শাসনের এই প্রচলিত ধারায় পরিবর্তন ঘটাতে হবে। তাহলেই সন্তানের সুস্থ বিকাশ সম্ভব—এমনটাই মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক দিলরুবা আফরোজ।
না মেরে বুঝিয়ে বলুন
দিলরুবা আফরোজ জানান, দুই বছর বয়স থেকেই শিশুরা শিখতে শুরু করে। তখন থেকেই তাকে ভালো কাজের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে। এ জন্য বড়দের নিজেদের আচরণের ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। যাতে তাঁদের নিজেদের কথা ও কাজের মধ্যে মিল থাকে। কারণ, শিশুরা বড়দের অনুকরণ করেই শেখে। অনেক সময় সন্তান কোনো ভুল করলে সঙ্গে সঙ্গে ওকে দোষারোপ করি। রাগ করি, শাস্তিও দেওয়া হয়। এটি আসলে ঠিক নয়। তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে, সে যে কাজটা করেছে, এর কুফল কী হতে পারত, কেন তাকে কাজটি করতে দেওয়া হয় না। এতে তার উপলব্ধির ক্ষমতা হবে। মা-বাবা রাগ করবেন বলে কাজটি করা যাবে না, তা নয়। কাজটি করা যে তার জন্য ভালো নয়, এই বোধ তার মধ্যে আসতে হবে। সামান্য ভালো কাজ করলেও তার প্রশংসা করুন। ছোট-ছোট পুরস্কারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে ভালো কাজ করার প্রবণতা গড়ে উঠবে। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি তাদের আকর্ষণ বেশি থাকে। হয়তো লুকিয়ে কোনো কাজ করে, না বলে কিছু খেয়ে ফেলে কিংবা মিথ্যা বলে। তারা ধরা পড়লে উচ্চ স্বরে আমরা বকা দিই। গায়েও হাত তুলি। কিন্তু এমনটি হলে সে শোধরাবে না। সে ক্ষেত্রে অভিভাবককে ধৈর্যশীল হতে হবে। প্রথমবার করা অপরাধের জন্য শাস্তি দেবেন না। কিন্তু বারবার একই কাজ করতে থাকলে মৃদু শাসন করতে পারেন। হতে পারে তাকে বললেন, দশ মিনিট দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকো। প্রিয় জিনিস থেকে কিছুক্ষণের জন্য সরিয়ে রাখলেন। তত্ক্ষণাত্ তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে যে কী কারণে এ শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। যাতে সে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। এমনটিও দেখা যায়, একই দুষ্টুমি আগে করেছে, তখন তাকে কিছু বলা হয়নি। কিন্তু হঠাত্ একদিন রেগে গিয়ে মারলেন। এটিও ঠিক নয়। শিশুর ভুলটা শুরুতেই ধরিয়ে দিতে হবে। সে কারণে শাসনটাও করতে হবে সুষ্ঠু প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। তবে অন্যের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ দিতে হবে। তবে মা-বাবাকে সবচেয়ে বেশি সময় দিতে হবে সন্তানকে। এতে শিশু আপনাকে বুঝবে। শাসনের পেছনের যুক্তিগুলো ধরতে পারবে।
সাহায্য করুন সিদ্ধান্ত নিতে
শিশুদের শাস্তি দিলে তারা এর কারণ মনে রাখে না। কিন্তু অভিভাবকের এই আচরণকে তারা নিষ্ঠুরতা হিসেবে নেয়। মনের মধ্যে ক্ষোভ জন্মে। এতে তাদের মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয়। লেখাপড়া নিয়ে অনেক অভিভাবক হুলস্থুল কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেন। এতে শিশুরা বিরক্ত হয়। অনাগ্রহের সঙ্গে লেখাপড়া করে। ফলে ভালো ফল করতে পারে না। তাই বুঝতে শেখার সময় থেকে বইয়ের সঙ্গে শিশুকে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। ঘুমাতে যাওয়ার আগে নানা ধরনের বই নিয়ে বিছানায় যান। এতে তারাও বই হাতে নিয়ে দেখবে, জানতে চাইবে। এভাবেও বিনা শাসনে লেখাপড়া করানো যায়। জানান, আনন্দ নিকেতন ইউরোপিয়ান স্কুলের অধ্যক্ষ সামসি আরা হাসান। তিনি আরও বলেন, ‘শিশুকে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করতে হবে। প্রতিটি বিষয়ের ভালো-মন্দ দুটি দিকই তার সামনে তুলে ধরতে হবে। দুপক্ষেই যুক্তি দেখাতে হবে। সেখান থেকে সে সিদ্ধান্ত নেবে। তাহলেই তার দুষ্টুমির প্রবণতা কমে আসবে। তাদের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে, যাতে তার সার্বিক বিকাশ হয়। বিশেষ করে স্কুলগুলোতে ভীতিহীন ও স্বাচ্ছন্দ্যময় পরিবেশ থাকতে হবে। শিক্ষকদের উচিত অন্য শিশুর সঙ্গে তাকে তুলনা না করা। শিশুর আত্মবিশ্বাস তৈরিতে সাহায্য করতে হবে। তার আবেগের জায়গায় যেন কোনো আঘাত না লাগে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ছোট থেকেই গুছিয়ে কাজ করার অভ্যাস তৈরি করুন। তবে যাই করুন না কেন, নিজের ভেতরের তাগিদ থেকে করতে হবে। মনে রাখবেন, শিশু কখনোই যেন নিরাপত্তাহীনতায় না ভোগে। এ জন্য অভিভাবকদের প্রশিক্ষণব্যবস্থা থাকা উচিত। যাতে তাঁরা কৌশলে শাসনের মধ্য দিয়ে সন্তানকে গড়ে তুলতে পারেন।
শাসন থাকবেই, তবে তা হবে ইতিবাচক
গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের শিশুবর্ধন ও পরিচর্যা বিভাগের অধ্যাপক মোরশেদা বেগম মনে করেন, শাসন থাকবেই, কিন্তু তা ইতিবাচকভাবে করতে হবে। কখনোই নেতিবাচক কথা তাদের সামনে বলা উচিত নয়।
শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। সে কারণে বড়রা অন্যদের সঙ্গে যা করছে, তারা তা শিখে ফেলে। ভবিষ্যতে তারাও সে রকম আচরণ করে। এ বিষয়ে পরিবারের সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। মাঝেমধ্যে তারা নানা কারণে জেদ করে। তাত্ক্ষণিকভাবে তা পূরণ করা সম্ভব না হলে কিংবা সামর্থ্য না থাকলে মারধর বা চিত্কার করা উচিত নয়। বরং তার মনটাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিন। পছন্দনীয় কোনো কাজ করতে দিন। তাতেও কাজ না হলে না শোনার ভান করুন। তাকে সময় দিন। ধীরে ধীরে বিষয়টি সে উপলব্ধি করতে পারবে। তাকে নিয়মানুবর্তী হতে শেখান। আসল কথা হলো, বুঝিয়ে বলুন। তাতেই টনিকের মতো কাজ হবে। সন্তানের সঙ্গে মধুর সম্পর্ক তৈরি করুন। তাতে যেন আপনার ও সন্তানের সমান অংশগ্রহণ থাকে।
তৌহিদা শিরোপা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ১৬, ২০১০
Leave a Reply