এক পাশে সাগর, আরেক পাশে উঁচু পাহাড়। এর মধ্য দিয়ে চলে গেছে ৮৪ কিলোমিটারের লম্বা ‘মেরিন ড্রাইভ’ কক্সবাজার-টেকনাফ সড়ক। কক্সবাজার শহর থেকে এ সড়ক ধরে ৩৫ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণে গেলে সামনে পড়ে সবুজ-শ্যামলে ভরা ইনানী গ্রাম। ইদানীং পর্যটকেরা ইনানী ভ্রমণ করছেন বেশি। এর কারণও আছে। ইনানী সৈকতের যে রূপ, তা অন্য কোনো সৈকতের নেই। এই সৈকতে পড়ে থাকা বিশাল পাথরস্তূপ সহজেই পর্যটকদের মন কাড়ে। ১২ মার্চ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অনেক পর্যটক সেই পাথরস্তূপে বসে আকাশের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন। কারণ একটাই। এত দিন সমুদ্রে দেখা যেত ডলফিন, কচ্ছপ, তিমি, জলপরি, মৎস্যকুমারী, জেলি ফিশ, লবস্টার, হাঙরের লাফালাফি আর দৌড়ঝাঁপ। এখন এই প্রাণীগুলো নানা রং ছড়িয়ে আকাশে উড়ছে। পর্যটকেরা অবাক চোখে তাকিয়ে দেখলেন, আকাশে শুধু সমুদ্রের প্রাণী নয়, উড়ছে বনের অজগর, গোখরা, স্যাটেলাইট (কৃত্রিম-উপগ্রহ), প্রজাপতি, মানুষ আকৃতির পাখি, বনমুরগিসহ নানা প্রজাতির পাখি আর কীটপতঙ্গ। মজার বিষয় হচ্ছে, এদের সঙ্গে উড়ছে বিশাল একটা গরুর গাড়িও। ছোট্ট শিশু আরেক কিশোরকে উদ্দেশ্য করে বলছে, ‘ওই দেখ, দুইটা সাদা গরুর গাড়ি এদিকে আসছে। তোর আজগর সাপটা ওদিকে সরা, নইলে বিপদ আছে।’
শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন এমনিতে ইনানী সৈকতে পর্যটকের উপচে পড়া ভিড় থাকে। এর ওপর পাহাড়ের সামনে, সৈকতের ওপর ঝলমলে পরিচ্ছন্ন আকাশটাতে উত্তরের হাওয়ায় উড়ছে সামুদ্রিক প্রাণিকুল। স্বভাবতই পর্যটকের উপস্থিতি আগের তুলনায় একটু বেশি হবে। ভ্রমণে আসা বিপুলসংখ্যক পর্যটক বালুচরে দাঁড়িয়ে, পাথরের ওপর বসে আকাশে নানা রং ছড়িয়ে উড়ে চলা সামুদ্রিক প্রাণীদের লাফালাফি আর দৌড়ঝাঁপ দেখে অভিভূত, মহা খুশি; যদিও তাঁরা সবাই জানেন, এসবের কোনোটির প্রাণ নেই। সবই ঘুড়ি।
ইনানী সৈকতে ঘুড়ি উৎসবের আয়োজন করে ঢাকার চারুশিল্পীদের সংগঠন ‘ছবির হাট’। ছবির হাটের জন্য এটি ষষ্ঠ আয়োজন। এর আগে ছবির হাটের উদ্যোগে কক্সবাজার সৈকতের লাবণী পয়েন্ট, সেন্ট মার্টিন দ্বীপে ঘুড়ি উৎসব হয়েছে। তবে ইনানী সৈকতে এই প্রথম।
২২ ঘুড়িয়াল বা চারুশিল্পী (ঘুড়ি যাঁরা তৈরি করেন), ৫০ জন উড়িয়াল (ঢাকা থেকে ঘুড়ি ওড়াতে আসা বিশিষ্টজন) ছাড়াও স্থানীয় শতাধিক শিশু-কিশোর এই ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসবে যোগ দেন। শিশু-কিশোরদের মধ্যে বিনা মূল্যে সরবরাহের জন্য তৈরি করা হয়েছিল প্রায় পাঁচ শ প্রজাতির ঘুড়ি। এই ঘুড়ি নিয়ে বাড়ি ফেরার সুযোগ পেয়ে শিশু-কিশোরেরা আনন্দে আত্মহারা।
‘অনেক কিছুর মতো ঘুড়ির ঐতিহ্যও ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে শিশুদের মুক্ত মনে উড়ে বেড়ানোর স্বপ্নও। ঘুড়িটা বড় কথা নয়, চাই শিশুমনে স্বপ্নবিকাশের পরিবেশ। এই উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়নে আজকের এই ঘুড়ি উৎসব।’ বললেন ছবির হাটের সদস্য, চারুশিল্পী, কার্টুনিস্ট বিপুল শাহ।
চারুশিল্পী সালেহিন মামুন জানান, উৎসবের আগের সাত দিন এই সৈকতে উড়িয়ালদের প্রশিক্ষণ কর্মশালা চলে। এখানে ঘুড়ি তৈরির নানা কৌশল নিয়ে উড়িয়ালদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষিত করে তোলা হয়। এঁরাই আবার সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েন শিশু-কিশোরদের প্রশিক্ষণ দিতে। ঘুড়ির সঙ্গে শিশুমনের স্বপ্ন উড়ুক—এটাই তাঁদের কামনা।
আরও কয়েকজন চারুশিল্পী বলেন, ‘এখানে সৈকতের নিরিবিলি পরিবেশে তৈরি করা ঘুড়িগুলোই আকাশে ওড়ানো হচ্ছে। বিদেশি নয়, আমরা নিজস্ব উদ্যোগে কচ্ছপ, মৎস্যকন্যা, হাঙর, ডলফিন, সাপসহ নানা ঘুড়ি তৈরি করেছি; যার সঙ্গে এ দেশের মানুষের ঐতিহ্যগত মিল রয়েছে।’
দুপুর ১২টা। প্রচণ্ড গরমে সৈকতের সাদা বালুতে আগুন জ্বলার মতো অবস্থা। কোনোভাবেই দাঁড়ানো যাচ্ছিল না। পা পুড়ে যাওয়ার পরিস্থিতি। ঢাকা থেকে ভ্রমণে আসা নাজনীন খন্দকার বলেন, ‘জীবনে প্রথম ঘুড়ি ওড়াচ্ছি। কত আনন্দ পাচ্ছি বলতে পারব না।’
কার্টুনিস্ট শিশির ভট্টাচার্য্যও অন্যদের সঙ্গে ডলফিন ঘুড়ি ওড়াচ্ছিলেন। বললেন, ‘বারবার ঘুড়িটা মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল। আকাশে ঘুড়ি ওড়াতে হলে কৌশল লাগে। ঘুড়ি নিয়ন্ত্রণ করাও অসাধ্য ব্যাপার। একা একা ঘুড়ি ওড়ানোর চেয়ে মিলেমিশে ওড়ানোর মধ্যে মজা অনেক।’
কক্সবাজারের কেজি স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র ফাহিম বাবাকে সঙ্গে নিয়ে এখানে ঘুড়ি ওড়াতে আসে। তার পছন্দ অজগর সাপ ঘুড়ি। কিন্তু এই সাপ ঘুড়ি ওড়ানো কঠিন ব্যাপার। তাই সে স্যাটেলাইট ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। এটিও ঠিকমতো ওড়ানো যাচ্ছে না। ফাহিমের সাফ জবাব, ‘শেষ পর্যন্ত দেখি না ঘুড়িটা ওড়াতে পারি কি না।’
জানা গেল, ১২ ফুট লম্বা সাপটি তৈরি করেছেন চারুশিল্পী সৌরভ সরকার। এটি তৈরি করতে তাঁর সময় লেগেছে নাকি পাঁচ দিন। বিশাল আকৃতির একটি গরুর গাড়ি তৈরি করতে কামরুজ্জামানের সময় লেগেছে সাত দিন। বিশাল এই গরুর গাড়িটি আকাশে তুলতে তাঁকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। নিজের ছেলে শাওনকের মতো করে একটি মনুষ্য পাখি তৈরি করেন কার্টুনিস্ট বিপুল শাহ। ছেলেকে কোলে নিয়ে প্রচণ্ড গরমের মধ্যে এই ঘুড়িটি আকাশে ওড়াচ্ছিলেন তিনি খুশিমনে। বললেন, ‘শাওনকের চেহারার সঙ্গে মানুষ আকৃতির এ পাখিটির কোনো পার্থক্য খুঁজে পাচ্ছেন? নিশ্চয় না। ছেলেকে খুব বেশি ভালোবাসি তো, তাই কষ্ট করে বানিয়ে ফেললাম।’
ব্যাঙের ছানার একটি ঘুড়ি তৈরি করে আকাশে ওড়াচ্ছেন ঘুড়িয়াল কানিজ ফারহানা। একই ভাবে চারুশিল্পী সালেহ মামুন তৈরি করেন একটি বিশাল অজগর সাপ, কচ্ছপ, রাশেদ তৈরি করেন ডেলটা, প্রজাপতি ও টিয়া পাখি।
অনেকের সঙ্গে মুক্ত আকাশে ঘুড়ি ওড়াতে পেরে মহা খুশি চট্টগ্রাম সালমন ক্যাডেট স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণীর ছাত্র মইনুল হোসেন খান। মইনুল বলে, ‘মা-বাবার সঙ্গে ইনানী সৈকতে বেড়াতে এসেছি। দেখি আকাশে নানা রকমের ঘুড়ি উড়ছে। ঘুড়ি উড়িয়ে খুব মজা পাচ্ছি।’
আয়োজকেরা জানান, ঘুড়ি ওড়ানোর পূর্বশর্ত হচ্ছে বাতাস। বাতাস ছাড়া ঘুড়ি ওড়ানো যায় না। এখানে মুক্ত আকাশ ও বাতাস দুটিই আছে। তাই উৎসবের জন্য ইনানী সৈকতকে বেছে নেওয়া হয়েছে। ছবির হাটের ঘুড়ি উৎসব মূলত একটি প্রতীকী উৎসব। আমরা চাই, এই উৎসবের ঢেউ গিয়ে লাগুক দেশের আনাচে-কানাচে। শিশুমনের স্বপ্নগুলো উড়ুক দেশের মুক্ত আকাশজুড়ে।
আব্দুল কুদ্দুস, কক্সবাজার
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ১৬, ২০১০
Leave a Reply