বন্ধু আর বন্ধুত্ব মানুষকে সুখে রাখে, সুস্থ রাখে। ভালো বন্ধু পেলে জীবন হয় আনন্দময়। ছেলেবেলার বন্ধুদের সঙ্গে যখন একত্র হওয়া যায়, তখন হৈহুল্লোড় করে মন এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। শরীরও সুস্থ হয়ে যায়, মনে হয় আয়ুও বেড়ে গেল। উৎসব-আনন্দে, সুখ-দুঃখে রাজদ্বারে, শ্মশানে সর্বত্র যে থাকে, সে-ই তো বন্ধু। শাস্ত্রের কথা হলেও এমন বন্ধু এখন পাওয়া প্রায় অসম্ভব। তবু বিপদ-আপদে যে পাশে থাকে, সে-ই তো বন্ধু। অস্ট্রেলিয়ায় জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের সিনিয়র সিটিজেন নিয়ে ১০ বছরের গবেষণায় দেখা যায়, প্রত্যাশিত গড় আয়ুর একটি বড় ভবিষ্যৎ সূচক হলো গাঢ় বন্ধুত্ব। ঘনিষ্ঠ পারিবারিক বন্ধনের চেয়েও জোরালো এই সূচক। পরিতৃপ্ত বন্ধুত্ব রক্ষা করতে পারে মানুষকে স্থূলতা, বিষণ্নতা ও হৃদরোগ থেকে অনেকটাই।
জীবনভর বন্ধু
সারা জীবনের বন্ধুটি বুড়ো বয়সে চোখে বাইফোকাল লেন্সের চশমা পরলেও দেখতে পায় ১৬ বছরের উচ্ছল তরুণীকে। স্টেজ দাপানো, নেচে বেড়ানো, অনেক ছেলেকে অনেকে দড়ি পরিয়ে ঘোরানো সেই তরুণীকে দেখতে পায়। এই বুড়ো বয়সেও মনে করিয়ে দেয়, যে রকম ছিল সে রকমই আছে। নর্থ ক্যারোলাইনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নামকরা বন্ধুত্ব-গবেষক ও সামাজিক বিজ্ঞানের অধ্যাপক ডক্টর রেবেকা জি অ্যাডামস বলেন সে কথা। দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা সত্যিই বিশেষজন। তিনি বলেন, ‘এ ছাড়া আর কে জানতে পারে আপনার পরিবারে যখন ছোট থেকে ধীরে ধীরে বড় হলেন, কে জানে এই বেড়ে ওঠার বয়সগুলোতে আপনাকে? ছেলেবেলার বন্ধু ছাড়া আর কে জানে এই অতীতের ইতিহাস।’ এই বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখা চাই। চিঠি লিখে, ফোন করে, মেইল করে, না হলে ফেসবুকের মাধ্যমে। পরিকল্পনা করুন বন্ধুদের সঙ্গে একত্রে বেড়াবেন অবকাশের সময়, ডিজিটাল ফটো অ্যালবামে সংযোগ ভাগাভাগি করুন না! কিছু না হলে মাঝেমধ্যে ছোট্ট চিঠি লিখলে হয়।
একজন নতুন বন্ধু
পুরোনো বন্ধুদের যেমন আপনার সম্পর্কে ধারণা আছে, নতুন বন্ধুদের কিন্তু তেমন আগে জানা কোনো ধারণা নেই। মনোবিজ্ঞানী ড· পামেলা ম্যাকলিন বলেন, ‘যত বুড়ো হই, আমরা যেন জীর্ণ হয়ে যাই।’ নতুন বন্ধুরা চিন্তাভাবনার নানা ধারাকে উসকে দেয়, এতে তাজা-টাটকা অনুভূতি পাওয়া যায়। এর চেয়ে বড় কথা হলো, নতুন বন্ধুরা অন্য কিছু লোকের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে দেয়। বলেন ভার্জিনিয়ার অধ্যাপক ডক্টর রোজমেরি ব্লিজনার, যিনি বয়স্ক নারীদের মধ্যে বন্ধুত্ব নিয়ে গবেষণা করেছেন। কর্মস্থল বা চাকরি বদলানোর প্রয়োজন হলে বা কোনো রোমান্টিক সঙ্গীর অন্বেষণে থাকলে এটি কাজে দেয়। বলেন রোজমেরি।
শরীরচর্চার বন্ধু
লেকের পার ধরে হাঁটতে হাঁটতে অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে পারে, উঠেছেও। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ব্যায়াম করা, যেমন-হাঁটা, গলফ খেলা, টেনিস খেলা, নৃত্য-যা-ই হোক, যেকোনো একটি করতে পারেন দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ও আয়ু বৃদ্ধির জন্য। কানেকটিকাট বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গবেষণা হয়েছিল ৫৯ থেকে ৭৮ বছর বয়সী ১৮৯ জন নারীকে নিয়ে। দেখা গেল, এক বছর পর্যন্ত ব্যায়ামের নতুন কর্মসূচি টিকিয়ে রাখার জন্য জোরালো সামাজিক সমর্থন প্রয়োজন। হাঁটতে হাঁটতে একটি লক্ষ্য স্থির করলে হাঁটার জন্য সঙ্গী পেলে ভালো। অনেক সময় স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে হাঁটতে পারলে ভালো। তা না হলে সমমনা কয়েকজন বন্ধু মিলে হাঁটা।
আত্মার বন্ধু, আধ্যাত্মিক বন্ধু
গবেষণায় দেখা গেছে, আধ্যাত্মিক কোনো গোষ্ঠীর সদস্য হলে মানুষের মধ্যে আসে স্থিতিস্থাপকতা। ডিউক ইউনিভার্সিটি মেডিকেল সেন্টারের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, যাঁরা নিয়মিত ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দেন বা ঈশ্বরের প্রার্থনা, ধ্যানচর্চা, ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠের মতো কাজ ও ধর্মাচার করেন, তাঁদের ছয় বছর কালের মধ্যে মৃত্যুবরণের আশঙ্কা, যাঁরা এসব কাজ করেন না, তাঁদের তুলনায় ৫০ শতাংশ কম। মসজিদ, মন্দির বা গির্জায় এসে ধর্মাচরণের সময় অনেকে পেয়ে যান এমন বন্ধু। এই বন্ধুদের সংস্পর্শে এসে আত্মা ও মনের যথেষ্ট উন্নতি হয়।
একজন তরুণ বন্ধু
আপনার ছেলেমেয়ে হতে পারে দুই প্রজন্ম ছোট, তবু এই তরুণ বন্ধুটি জানতে চায় অনেক কিছু। গবেষণায় দেখা গেছে, অন্যের কাছে উপকারী কোনো কাজ লালন করা বা অনুভবে রাখা হলো সুখী জীবনের চাবিকাঠি। মানুষ চায় পুরোনোদের অভিজ্ঞতার অংশীদার হতে। জীবনে ঠেকে যা শিখলেন, এই অভিজ্ঞতা অন্যকে দিলে তবে না বেশ হলো। সন্তান লালন-পালন করে অনেক নারী এ অভিজ্ঞতা কাজে লাগান, পুষিয়ে নেন খায়েশটা। কিন্তু একসময় হয় যখন বাচ্চারা বড় হয়ে ঘরের বাইরে চলে গেল, নিজের মতো করে সংসার গড়ে নিল, একা হয়ে গেলেন-তখন তরুণ ছোট বন্ধুদের তদারকি করে পুরোনো স্বাদ ফিরে পাওয়া যায়। এই বন্ধুত্বের সুফল পাওয়ার জন্য দুই তরফ থেকে আন্তরিকতা চাই।
যে বন্ধু সমমর্মী হতে পারে
জানেন, একজন নারী যখন ঋতু বন্ধের সীমানায় পৌঁছে যান, তখন সমবয়সী একজন বন্ধু পেলে যারপরনাই খুশি হন। একজন, যার জীবনটা একই রকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেল, তেমন বন্ধু পেলে পড়তি বয়সে শরীরের উষ্ণ ঝিলিক কিছুটা হয় শীতল, শূন্য নীড় একটু কম একাকী মনে হয়। একই বয়সের বান্ধবী বুঝতে পারেন বন্ধুর সমস্যা। তাই খুঁজে নিতে হয় সাপোর্ট গ্রুপ, দুজন দুজনকে সাহায্য করতে পারেন, একটু কঠিন কাজের বাইরে এসে জীবনকে উপভোগ করা-কেমন হয়?
তবু শেষে বলি, বন্ধু নিয়ে একটি গান ছোটবেলায় সিনেমায় দেখেছিলাম, এখনো কানে বাজে-এমন বন্ধু আর কে আছে? তোমার মতো সিস্টার?
কখনো বা ডার্লিং, কখনো বা জননী
কখনো বা স্মেহময়ী সিস্টার?
বন্ধুরা, মনে করে দেখুন তো কোন ছবির গান, কে গেয়েছিলেন।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস
বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ১১, ২০০৯
Leave a Reply