ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম দীর্ঘদিন ধরে কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিষয়টি পড়াচ্ছেন। তিনি আপনার বিভিন্ন মানসিক সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন। আপনার সঠিক পরিচয় না দিতে চাইলে অন্য কোনো নাম ব্যবহার করুন। যে সমস্যার কথা আপনি ছাপতে চান না, তা লিখে পাঠাবেন না। খামের ওপর অবশ্যই ছুটির দিনে মনের জানালা কথাটি লিখবেন। —বি.স.
সমস্যা: আমি ইডেন কলেজে অনার্স তৃতীয় বর্ষে (অর্থনীতি) পড়ছি। দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় একটা ছেলের সঙ্গে আমার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সম্পর্কের ছয় মাসের মাথায় আমাদের এলাকায় একটা গুজব রটে যায়, আমি নাকি কোর্ট ম্যারেজ করেছি। আমার মা-বাবা তখন আমাকে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে রাখেন। এদিকে আমাদের প্রতিপক্ষের কেউ একজন ছেলের বাবাকে বলেছে, ছেলেটি নাকি আমাকে পড়াশোনার খরচ এবং আমার বাবাকে টাকা দেয়। ছেলের বাবা এলাকার অনেককেই এ কথা জানায়। ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল সত্যি, তবে প্রেমের সঙ্গে টাকা দেওয়ার কী সম্পর্ক! এরপর কিছুদিন আমার পড়াশোনা বন্ধ থাকলেও কদিন পর আবারও পড়াশোনা শুরু করি। গত সাতটা বছর আমি ছেলেটির সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখিনি, রাখতে চাইওনি—কেননা সে আমাকে ছোট করেছে। আমি ওকে বিয়ে করব না, এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখন মনে হয়, সাত বছর আগের সম্পর্কটা ছিল আমার বয়সের ভালো লাগা। বাস্তব জীবনে সে ভালো লাগার কোনো গুরুত্ব নেই। আমি অনেক পড়াশোনা করতে চাই। কিন্তু একটা ভয় তাড়া করে আমকে—সামনে যে আমার জীবনসঙ্গী হবে, সে কি এই প্রেমের কথা মেনে নিতে পারবে? সে কি আমাকে ভালোবাসবে?
মৃন্ময়ী, ঢাকা।
পরামর্শ: বয়ঃসন্ধিতে আবেগপ্রবণ হয়ে তুমি কাউকে ভালোবেসেছিলে। কিন্তু পরে তোমাকে এর জন্য অনেক বেশি মূল্য দিতে হয়েছে। এই বয়সের ছেলেমেয়েরা প্রায়ই এ ধরনের ভুল করে। এসব পরিস্থিতিতে পরিবারের সদস্যরা অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখালে বেশ জটিলতার সৃষ্টি হয়। পরিবারের আপন মানুষগুলো যদি তখন ধৈর্যের পরিচয় দেন, তাহলে ভালো হয়। তাঁরা যদি সন্তানদের অল্প বয়সে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার সুবিধা-অসুবিধাগুলো তুলে ধরতে পারতেন, তাহলে এত কষ্ট পেতে হতো না। সবাই যে তোমাকে একটি স্পর্শকাতর বয়সে এতটা বিপর্যস্ত করেছে, সেটি খুবই দুঃখজনক। ছেলেটির পরিবারের ভূমিকাটিও অত্যন্ত অনাকাঙ্ক্ষিত। আমাদের সমাজ যেহেতু বিয়ের আগে প্রেমের সম্পর্কের ব্যাপারে বেশ রক্ষণশীল, তাই এ ব্যাপার ঘটলে পরিবারগুলো একটু বেশি মাত্রায় নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া করে ফেলে। তুমি তো এখন ভুল বুঝতে পেরেছ এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছ অনেক পড়ালেখা করবে, সেটি কিন্তু খুব প্রশংসনীয়। তবে তুমি যে ভবিষ্যত্ নিয়ে ভয় পাচ্ছ, সেটি কতটা বাস্তবসম্মত তা ভেবে দেখো। ভবিষ্যতে কী হবে, আমরা কেউ তা জানি না। তাই এ চিন্তাগুলোকে প্রশ্রয় না দেওয়াই বেশি যুক্তিসংগত। মানুষের প্রতি তোমার বিশ্বাস হয়তো কিছুটা নষ্ট হয়েছে, কিন্তু এখনো যে পৃথিবীতে অনেক ভালো ও উদার মনের মানুষ আছে—এ বিশ্বাসটা ধরে রাখার চেষ্টা করো। যারা গুজব শুনে ভয় পায়, তাদের নিশ্চয়ই তুমি বিবেচনায় রাখবে না। পরবর্তীকালে যার সঙ্গে তোমার বিয়ে হবে, তার কাছে তোমার অতীত কতটা জানাবে—সেটা সময়ই বলে দেবে। তোমার জীবনসঙ্গীরও তো বিশেষ কোনো অতীত থাকতে পারে, তাই না? বিয়ের পর দুটো মানুষের প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে, পুরোপুরি আন্তরিক হয়ে বিয়ের পবিত্র বন্ধনকে দৃঢ় করার জন্য প্রচেষ্টা ও মনোযোগ দেওয়া। পেছনে কী ঘটেছিল সেই ব্যাপারগুলো নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামালে অনেক অশান্তি আর জটিলতার সৃষ্টি হয়। দুজনের সম্পর্কের মধ্যে যথেষ্ট শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস তৈরি হওয়ার পর তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারে, নিজেদের একান্ত বিষয়গুলোতে কতটা খোলামেলা হওয়া সম্ভব।
সমস্যা: কলেজে ভর্তি হওয়ার কয়েক দিন পরই আমি আমাদের ক্লাসের একটি মেয়ের প্রেমে পড়ি। মেয়েটি আমাকে অনেক বেশি ভালোবাসত। এখনো অনেক ভালোবাসে। আমিও তাকে আমার মন থেকে ভালোবাসতাম। কিন্তু ইন্টারমিডিয়েট ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার পর আমাদের প্রেমের বিষয়টি জানাজানি হলে পারিবারিক জটিলতার জন্য তার সঙ্গে আস্তে আস্তে আমার যোগাযোগ কমতে থাকে। এর ফলে আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে থাকি। তার এই শূন্যতা কাটিয়ে ওঠার জন্য আমি নতুন করে অন্য দুজনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি। প্রথম দিকে যদিও আমার নতুন প্রেমের মধ্যে আন্তরিকতার কোনো বালাই ছিল না, কিন্তু আস্তে আস্তে আমি সত্যি তাদের প্রতি দুর্বল হয়ে গেছি। আমার নতুন দুই প্রেমিকার মধ্যে একজন আমার বান্ধবী আর অন্যজন বিবাহিত এক মহিলা। বিবাহিত মহিলার দুটি সন্তান রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে তিনজনই আমাকে খুব ভালোবাসে, তবে তাদের কেউই একে অন্যের কথা কিছুই জানে না। এসব কারণে নিজেকে খুবই অপরাধী মনে হচ্ছে। মাঝেমধ্যে ভাবি, তিনজনের কাছেই সব বলে দেব।
মো. উইন আহম্মেদ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
পরামর্শ: তুমি যে তিনজনের সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি করেছ, সেটি তো নৈতিকভাবে বা সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য আচরণ নয়, তাই না? তোমার প্রথম সম্পর্কটি হয়েছিল অপ্রাপ্ত বয়সের অতিরিক্ত আবেগের কারণে। তবে শূন্যতা কাটানোর জন্য তুমি যে পরবর্তীকালে একই সঙ্গে দুজনের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করলে সেটি ভুল হয়েছে। তুমি লিখেছ, প্রথম দিকের প্রেমে তুমি আন্তরিক ছিলে না। তুমি কি তাহলে তাদের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করেছিলে? সত্যিকার অর্থে, তুমি তো তাহলে তাদের দুজনের সঙ্গেই প্রতারণা করছ, তাই না? যে মেয়েটি বিবাহিত, সেও কিন্তু তার স্বামী ও সন্তানদের প্রতি অবিচার করছে। আসলে একটি সম্পর্ক ভেঙে গেলে আমাদের মনে শূন্যতা তৈরি হয়। কিন্তু সেটি কাটাতে গিয়ে আমরা যদি নিজের আবেগ ও চিন্তাগুলোকে ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণে আনার আগেই অন্য সম্পর্ক তৈরি করতে শুরু করি, তাহলে নিজের প্রতি আর অন্যের প্রতি অবিচার করা হয়। শূন্যতা কাটানোর জন্য আমাদের কিছু সুস্থ বিনোদন ও সুস্বাস্থ্য তৈরির কথা ভাবতে হবে। যেমন, নিয়মিত মানসিক রিলাক্সেশন, শরীরচর্চা করা, ভালো বই পড়া ও ছবি দেখা, ভালো বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো, দূরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া ইত্যাদি। আমি মনে করি, তোমার অকপটে ও সততার সঙ্গে দুটো মেয়েকেই বলে দেওয়া উচিত। তাদের কাছে খুব আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করলে তারা ঠিকই বুঝতে পারবে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ১৩, ২০১০
Leave a Reply