পড়তে কিংবা লিখতে শেখার শুরুতে শিশুকে নিয়ে নানারকম ঝক্কি পোহাতে হয় কমবেশি সব বাবা-মা’কেই। তবে একটু ধৈর্য ধরে আর খানিকটা কৌশলে শিশুর মনস্তত্ত্বটাকে মাথায় রেখে তাকে পড়ানো গেলে এসব সমস্যা থেকে অনেকাংশেই রেহাই পাওয়া যায়। ‘কড়চা’র এবারের মূল আয়োজনে রইলো শিশুর আনন্দদায়ক শিক্ষার এমনই কিছু দিক নিয়ে আলোচনা। লিখেছেন হাসান মাহমুদ
সারা দিনমান যে শিশুটি দিব্যি মনের আনন্দে আর স্বাভাবিক চঞ্চলতা নিয়েই ঘুরে বেড়াচ্ছে পড়তে বসে সেই শিশুর মাথাতেই কোথা থেকে যেন ভর করে রাজ্যের দুষ্টুমি। কখনো ঘুমের ভান করে আবার কখনো বা টিভি দেখার বায়না ধরে আপনার লক্ষ্মী ছেলে কিংবা মেয়েটিই হয়তো তখন বাড়ি মাথায় তোলে। আর শিশুর এই শিশুতোষ গোলমালে হয়তো হুট করেই মেজাজ হারিয়ে ফেলেন আপনি। শুরু হয় অহেতুক শাসন। আবার কেউ হয়তো অতিমাত্রায় হতাশ হয়ে শিশুর গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করেন না। তবে পড়ালেখার এই গোলমালে অতি শাসনে ভাল ফল পাবার সংখ্যা কিন্তু নেহাতই হাতেগোনা। তার উপর শিক্ষার বিষয়টি যখন ক্রমে ক্রমেই শিখার চেয়ে বুঝার বিষয় হয়ে উঠছে তখন এভাবে পড়াশোনা এগিয়ে নিয়ে শিশুর ভবিষ্যতের জন্য একটি ভাল ভিত্তি গড়ে দেয়াটাও প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। আর এ কারণে পড়তে কিংবা লিখতে শেখার শুরু থেকেই এই প্রক্রিয়াটি যেন শিশুর জন্য আনন্দদায়ক হয়ে ওঠে সে বিষয়টির প্রতি লক্ষ্য রাখা প্রতিটি মা-বাবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।
সাধারণত অবস্থাভেদে শহর কিংবা গ্রামে তিন থেকে পাঁচ বছর বয়সেই অধিকাংশ শিশুর লেখাপড়ায় হাতেখড়ি হয়। এই সময়টাতে এমনিতেই শিশুরা তাদের আশপাশের অনেক কিছু দেখে শিখতে থাকে। তবে আশপাশের জগৎ থেকে শিশুর এই শিখে নেয়ার প্রক্রিয়াটিতে কোনো ধরনের বাধ্যবাধকতা থাকে না বলেই শিশুরা আনন্দের সঙ্গেই ভাষা শিক্ষার মতো বিষয়গুলো চালিয়ে যায়। আর এ কারণেই কথা বলা শেখার জন্য কখনোই শিশুকে শাসন করতে হয় না। পড়াশোনার ক্ষেত্রেও যদি এই বিষয়টির প্রতি লক্ষ্য রেখে এগুনো যায় তাহলে শিশুর শিক্ষার অভিজ্ঞতাটি হয় অনেক সুখকর।
যে বয়সে একটি শিশু পড়ার চেয়ে খেলতেই বেশি ভালোবাসে সে বয়সে শিশুকে ধরে-বেঁধে নিয়ম করে পড়তে বসালে তা স্বভাবতই তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে চলে যায়। কাজেই শিশুর আনুষ্ঠানিক পড়াশোনা শুরুর বেশ অনেকদিন আগে থেকেই তাকে একটু একটু করে পড়াশোনার আবহের সাথে পরিচিত করে তুলতে হবে। খেলার ফাঁকে ফাঁকে শিশুকে বিভিন্ন ছড়া শোনানোর মাধ্যমে তাকে বিষয়গুলোর প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে। এছাড়া শিশুর মাঝে যদি গল্প শোনার ঝোঁক থাকে তাহলে তাকে পাশে নিয়ে কোনো একটি বই থেকে শিশুকে মজার মজার গল্প পড়ে শোনান। এক্ষেত্রে গল্পগুলো যদি শিশুর ভাল লাগে তাহলে সে নিজেও গল্প পড়ার জন্য কীভাবে বানান করে পড়তে হয় তা শিখতে আগ্রহী হবে।
পড়তে কিংবা লিখতে শেখার জন্য শিশুকে নিয়ে প্রতিদিন একটা সময় নিয়ম করে পড়তে বসতে হবে এমন কোনো ধরাবাঁধা নিয়মে প্রথমদিকে না যাওয়াই ভাল বরং কখনো বিভিন্ন অক্ষর দেখানোর মাধ্যমে আবার কখনো বা সুর করে বর্ণমালা পড়ার মাধ্যমে শিশুর চোখ ও কানকে পড়ালেখার উপযোগী করে গড়ে তুলুন। আর এ কাজগুলো খেলাচ্ছলে এমনভাবে এগিয়ে নিয়ে যান যেন শিশুর কিছুতেই মনে না হয় যে তাকে চাপ দিয়ে কিছু শেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এমনকি প্রথমদিকে আপনার শিশু একটি জিনিস শেখার পর তা কিছুক্ষণের মধ্যে ভুলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। কাজেই এ জন্য শিশুকে শাসন না করে প্রতিবার তাকে ঠিকটা শুধু মনে করিয়ে দিন।
শিশুর লেখাপড়া শেখার জন্য পরিবেশও অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আপনি তাকে পড়তে বলে নিজে টিভি দেখতে বসে যাবেন এমনটা যেন কখনোই না হয় বরং শিশুর পাশে থেকে তাকে বোঝান যে পড়ালেখার এই সময়টাকে আপনিও গুরুত্বের সঙ্গেই নিচ্ছেন এবং তার পাশেই আছেন। যদি সম্ভব হয়, তাহলে শিশুর জন্য আলাদা একটি পড়ার রুমের ব্যবস্থা করে দিন। তা সম্ভব না হলে শিশু যে রুমে ঘুমায়, সেই রুমের কোনায় একটি রিডিং টেবিল দিয়ে দিন। টেবিলের গায়ে শিশুর প্রিয় কার্টুন চরিত্রের স্টিকার লাগিয়ে দিন। এই রুমে তার খেলনাগুলিও রাখতে পারেন। অনেক সময়ই দেখা যায়, মনের মতো পরিবেশের অভাবেও শিশু পড়তে চায় না। কাজেই আপনার শিশুর ক্ষেত্রে এটি প্রথম থেকেই নিশ্চিত করার চেষ্টা করুন।
সাধারণত অধিকাংশ শিশুর ক্ষেত্রেই পড়তে শেখার প্রক্রিয়াটি যতো দ্রুত এগোয় ঠিক ততোটা দ্রুততার সাথে লেখা শেখার বিষয়টি এগোয় না। এক্ষেত্রে অনেক বাবা-মা’ই একেবারে প্রথম দিন থেকেই শিশুর হাতে চক বা পেন্সিল তুলে দিয়ে তাকে লেখা শেখানোর চেষ্টা করেন। তবে চক বা পেন্সিল হাতে দেবার আগে শিশুকে যদি বিভিন্ন খেলার সামগ্রি দিয়ে বা ছোট ছোট খেলনা দিয়ে বর্ণমালা তৈরি করতে শেখান তবে তার প্রাথমিক ভিত্তিটা সহজেই তৈরি হয়ে যাবে। এছাড়া অক্ষর লিখতে শেখার আগে তাকে বেশি বেশি করে অক্ষর চেনানোর প্রতি জোর দিন। শিশুর হাতে ছোট ছোট নুড়ি তুলে দিয়ে সেগুলো দিয়ে তাকে বর্ণমালা তৈরি করতে উৎসাহ দিন। আর এভাবে বর্ণমালার সাথে তার একটা সম্পর্ক গড়ে উঠলে আস্তে আস্তে চক বা পেনসিল দিয়েও তাকে লিখতে শেখান। এছাড়া শিশু যাতে পেন্সিল ঠিকমতো ধরতে শেখে এজন্য তাকে প্রথম থেকেই বর্ণমালা লিখতে না দিয়ে কাগজে নিজের মনমতো আঁকিবুকি করতে দিন।
বাসায় বেশ কিছুদিন প্রস্তুতি নেয়ার পর শিশু যখন স্কুলে যেতে শুরু করে তখন থেকেই শুরু হয় মা-বাবার আরেক ভাবনা। প্রায়শই দেখা যায় যে, শিশুরা স্কুলের পরিবেশের সাথে সহজে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না। আবার স্কুল সম্পর্কে একধরনের ভীতিও জন্ম নেয় অনেকের মাঝে। এক্ষেত্রে স্কুল সম্পর্কে শিশুকে উৎসাহিত করে তোলা বা স্কুলের পরিবেশের সাথে তাকে মানিয়ে নেয়ার সুযোগ করে দিতে মা-বাবাকেই এগিয়ে আসতে হয়। শিশুর কাছে যেন স্কুলটাকে কঠিন কোনো জায়গা মনে না হয় সেজন্য স্কুল থেকে ফিরলে তাকে পড়াশোনার কথা জিজ্ঞেস না করে আগে বন্ধুদের কথা জিজ্ঞেস করুন। স্কুলের সব পড়াশোনা পারতেই হবে এমন চাপ তৈরি না করে আগে স্কুলে নিয়মিত যাতায়াতের জড়তাটুকু কাটানোর চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে শিশুর সাথে সাথে আপনিও স্কুলে যেয়ে তাকে বন্ধু তৈরিতে উৎসাহ দিন। সেই সাথে শিশুকে এটা বোঝান যে, এইসব পড়াশোনা তার জন্য মামুলি বিষয় এবং সে ঠিকই এগুলো সময়মতো শেষ করতে পারবে।
এমনিতেই নিয়ম-শৃঙ্খলার কারণে অনেক শিশুর কাছে স্কুল একটি কঠিন জায়গা হয়ে ওঠে। কাজেই স্কুল থেকে ফেরার সাথে সাথে শিশুকে আবারো পড়তে বসার জন্য চাপ দেবেন না বরং তাকে ইচ্ছাস্বাধীন ভাবে কিছুক্ষণ কাটাতে দিন। এই সময় শিশু যদি খেলতে চায় বা টিভি দেখতে চায়, তাহলে তাকে বাধা দেবেন না। তারপর আস্তে আস্তে তাকে স্কুলের পড়ার কথা জিজ্ঞেস করুন এবং তাকে সাথে নিয়ে স্কুলের কাজগুলো শেষ করতে সাহায্য করুন।
একটি স্কুলে সবাই প্রথম হয় না। কাজেই আপনার শিশুকে প্রথম হতেই হবে এমন ধরনের চাপ তার উপর কখনোই দেবেন না বরং শিশুকে এভাবে আত্মবিশ্বাসী করে তুলুন যে সে যদি ঠিকমতো দিনের পড়া দিনেই শেষ করতে পারে তাহলে তার ফলাফল অবশ্যই অন্য অনেকের চেয়ে ভাল হবে। সেই সাথে শিশু যেসব বিষয় পড়ছে সেগুলো যেন সে বুঝে বুঝে পড়তে পারে সেদিকে খেয়াল রাখুন। প্রয়োজনে বই এর বাইরে সহজ কোনো উদাহরণ দিয়ে তাকে বিষয়টি বুঝতে শেখান। মনে রাখবেন, শিশু’র জন্য পড়ার একটি পরিবেশ তৈরি করে দেয়াই আপনার কাজ। আর সে কীভাবে পড়ালেখা আত্মস্থ করবে এটি তার উপরই ছেড়ে দিন।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, মার্চ ০৯, ২০১০
Leave a Reply