মূত্রতন্ত্রের যত রোগ আছে, এর মধ্যে পাথরজনিত রোগ সবচেয়ে বেশি। প্রতি ২০ জনের মধ্যে একজন কিডনির পাথরে ভোগে। পাথর আকারে খুদে শস্যদানা থেকে শুরু করে টেনিস বল আকৃতির পর্যন্ত হতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার আগেই ছোট পাথরগুলো প্রস্রাবের সঙ্গে বের হয়ে যায়। কিন্তু যেগুলো উপসর্গ তৈরি করে তাদের চিকিৎসা নিতে হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বড় রকমের কোনো শল্যচিকিৎসার (সার্জারি) প্রয়োজন হয় না। এখন পাথর হওয়া প্রতিরোধ করাও সম্ভব।
কাদের বেশি হয়
নারীদের তুলনায় পুরুষদের পাথর হওয়ার হার বেশি (৩ঃ১)। ৪০ বছরের পর থেকে পুরুষদের পাথর হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে, ৭০ পর্যন্ত বাড়তেই থাকে। নারীদের ক্ষেত্রে তা ৫০ বছর বয়স থেকে বাড়তে থাকে। তবে যেকোনো সময়েই যে কারও কিডনি বা মূত্রতন্ত্রে পাথর হতে পারে। এ ছাড়া যাদের একাধিকবার পাথর হয়েছে, তাদের বারবার হতে পারে। যাদের প্রস্রাবের প্রদাহ বেশি হয়, টিউবুলার এসিডোসিস রয়েছে, তাদেরও। টিউবুলার এসিডোসিস একটি বংশগত রোগ। এই রোগীর ৭০ শতাংশেরই কিডনিতে পাথর হয়।
যেসব লক্ষণ দেখা যায়
কিডনি ও মূত্রতন্ত্রে পাথর হলে অনেক ক্ষেত্রেই কোনো লক্ষণ বা উপসর্গ থাকে না। তবে পাথর আকারে একটু বড় হলে লক্ষণ দেখা দেয়।
যেমন-কোমরের পেছন থেকে শুরু করে কোমরের পাশে, কুঁচকি, তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। ব্যথা জননেন্দ্রিয়েও হতে পারে। থেকে থেকে ব্যথা আসে, অসহ্য তীব্র মাত্রায়।
ব্যথা এতই তীব্র হয় যে শরীরের অবস্থান পরিবর্তন করলেও কোনো উন্নতি হয় না। সঙ্গে বমি বমি ভাব থাকে, বমিও হতে পারে। প্রস্রাবের রং লাল হতে পারে বা প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যেতে পারে। মূত্রতন্ত্রে ইনফেকশন থাকলে জ্বর ও কাঁপুনিও হয়। বৃক্কনালি দিয়ে পাথর মূত্রপথের কাছাকাছি চলে এলে প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া, ঘন ঘন প্রস্রাব হতে পারে। পাথর মূত্রতন্ত্রের নালি বন্ধ করে দিলে কিডনি নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
রোগ নির্ণয়
প্রথমত, রোগের ইতিহাস জানতে হবে। আগে কখনো কিডনি বা মূত্রতন্ত্রে পাথর ধরা পড়েছিল কি না, বর্তমানে ব্যথা থাকলে, এর প্রকৃতি ইত্যাদি জানতে হবে। দ্বিতীয়ত, কিছু পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে এক্স-রে ও আলট্রাসাউন্ড। অনেক ক্ষেত্রে কিডনির পাথর নীরব থাকে। উপসর্গবিহীন অবস্থায় পাথর নির্ণয় করতে হলে আলট্রাসনোগ্রাম অত্যন্ত জরুরি। তৃতীয়ত, প্রস্রাব ও রক্ত পরীক্ষা করে কিডনির কার্যকারিতা সম্পর্কে জানা দরকার। প্রয়োজনবোধে সঠিক চিকিৎসার জন্য পাথর কোথায় অবস্থান করছে, তা সঠিকভাবে নির্ণয় করার জন্য আইভিইউ এক্স-রে বা হেলিকেল সিটিস্ক্যান করা যেতে পারে। চতুর্থত, ২৪ ঘণ্টার প্রস্রাবে ক্যালসিয়াম, ইউরিক এসিড, সিস্টিন ইত্যাদির পরিমাণ দেখা হয়। এই পরীক্ষা মূলত পাথর প্রতিরোধের জন্য দরকারি।
চিকিৎসা
থেরাপি দেওয়াঃ কিডনিতে পাথর মানেই অস্ত্রোপচার-এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। বেশির ভাগ পাথরই বড় ধরনের কোনো অস্ত্রোপচার ছাড়াই ভালো করা হয়ে যায়। বৃক্কনালিতে পাথরের আকার যদি ৫ মিমি বা তার কম হয়, তবে শতকরা ৯০ ভাগের বেশি ক্ষেত্রে তা প্রস্রাবের সঙ্গে আপনা-আপনি বেরিয়ে যেতে পারে।
তবে ১০ মিমির বেশি হলে, তা বেরিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। বেশি পরিমাণে পানি পান করা দরকার। প্রতি এক ঘণ্টা পরপর এক গ্লাস পানি পান করা যেতে পারে। জগিং করা। এর সঙ্গে ট্যামসলোসিন এবং ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার-জাতীয় ওষুধ, নিফিডিপিন যোগ করলে বৃক্কনালি স্কিত হয় এবং পাথর প্রস্রাবের সঙ্গে বেরিয়ে যেতে পারে।
শল্য চিকিৎসা
পাথরের আকার যদি এত বড় হয় যে নিজে থেকে বের হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই তাহলে শল্যচিকিৎসার প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া যদি বারবার প্রস্রাবের ইনফেকশন হয়, পাথরের কারণে কিডনি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়, পাথরের আকার বেড়েই চলে, পাথরের কারণে প্রস্রাবের সঙ্গে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়, তাহলে শল্যচিকিৎসা লাগে। প্রধানত চার ধরনের শল্যচিকিৎসা রয়েছে। এগুলো হলো, এক্সট্রা করপোরিয়াল শকওয়েভ লিথোট্রিপসি (ইএসডব্লিউএল), পিসিএনএল, ইউরেটেরোস্কোপিক পদ্ধতি ও ল্যাপারোস্কোপিক পদ্ধতি।
ইএসডব্লিউএলঃ এ ব্যবস্থায় শক্তিশালী তরঙ্গ পাথরে আঘাত করে টুকরো টুকরো করে দেয়। পরে টুকরো পাথর প্রস্রাবের সঙ্গে বেরিয়ে আসে। বেশি বড় পাথর হলে এবং সংখ্যায় বেশি হলে এই পদ্ধতিতে তা বের করা যায় না। বৃক্কনালি ও মূত্রথলির পাথর এই ব্যবস্থায় বের করে আনা সম্ভব নয়। এই পদ্ধতির সুবিধা হলো মাত্র ২০-৩০ মিনিট সময় লাগে। রোগীকে অজ্ঞান করা হয় না। চিকিৎসার দু-তিন ঘণ্টা পর রোগীকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
পিসিএনএলঃ যদি পাথরের আকার বড় হয়, তখন ভাইব্রেশন দিয়ে কিডনির পাথর গুঁড়ো করা হয়, যা প্রস্রাবের সঙ্গে নেফ্রোসটমি টিউব দিয়ে বেরিয়ে আসে। পরে প্রয়োজনবোধে ইএসডব্লিউএল করা হয়।
ইউরেটেরোস্কোপিকঃ এই ব্যবস্থায় ছোট্ট ফাইবার স্কোপ মূত্রপথ, প্রস্রাবের থলি হয়ে বৃক্কনালি থেকে পাথর গুঁড়ো করে অথবা বাক্সেট দিয়ে ধরে পাথর বের করে নিয়ে আসা হয়।
ল্যাপারোস্কোপিকঃ এখন এই পদ্ধতিতে বিভিন্ন অস্ত্রোপচার করা হচ্ছে। ছোট ছোট দু-তিনটি ছিদ্র করে ক্যামেরার মাধ্যমে সহজেই পাথর বের করা যায়। এই ব্যবস্থায় জটিলতাও কম।
কীভাবে প্রতিরোধ করবেন
মূলত খাদ্যাভাস পরিবর্তন এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তন আপনাকে কিডনিতে পাথর হওয়া থেকে মুক্ত রাখতে পারে। পাথরের কেমিক্যাল অ্যানালাইসিস, রক্ত ও ২৪ ঘণ্টার প্রস্রাব পরীক্ষা করে পাথর সৃষ্টিকারী বিভিন্ন উপাদান শনাক্ত করা অত্যন্ত জরুরি। নিচের উপায়গুলো অনুসরণ করা যায়-
— প্রচুর পরিমাণে পানি পান করা। প্রতিদিন গড়ে তিন-চার লিটার পানি পান করা উচিত। যাঁরা বিভিন্ন কারখানায় কাজ করেন, যেখানে প্রচণ্ড ঘাম হয়, যেমন-গ্লাস ফ্যাক্টরি, স্টিল মিল, মধ্যপ্রাচ্যের আবহাওয়ায়, তাঁদের এর চেয়ে বেশি পানি পান করতে হবে। মনে রাখতে হবে, প্রস্রাবের রং যেন পানির মতো হয়।
— আগে বলা হতো, ক্যালসিয়াম-জাতীয় খাবার খেলে ক্যালসিয়াম পাথর বেশি হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, খাবারের সঙ্গে ক্যালসিয়াম খাদ্যনালিতে পাথর সৃষ্টিকারী অক্সালেটের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পায়খানার সঙ্গে বের করে দেয়। কাজেই ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবার, যেমন-দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার খাওয়া যাবে। তবে যাদের একটি কিডনিতে একবার পাথর হয়েছে, তাদের অপ্রয়োজনীয় ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট ও ভিটামিন ডি খাওয়া একেবারেই অনুচিত।
— যাদের কিডনিতে একবার পাথর ধরা পড়েছে, তাদের ভিটামিন ডি-জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।
— মাংস, মাছ ও পোলট্রি-জাতীয় খাবার কম খেতে হবে।
— খাবারের সঙ্গে অতিরিক্ত লবণ খাওয়া যাবে না।
— যাদের হাইপারপ্যারাথাইরয়েড রোগ রয়েছে, তাদের দ্রুত তা অস্ত্রোপচার করা উচিত।
আরও কিছু
— বংশে কিডনিতে পাথর রোগের ইতিহাস অথবা কারও একাধিক পাথর থাকলে তাদের পুনরায় পাথর হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
— ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তির প্রস্রাব ও রক্ত পরীক্ষা করে পাথর সৃষ্টি সম্পর্কে আগাম অনুমান করা সম্ভব।
— কারও কারও ক্ষেত্রে পাথর সৃষ্টির ঝুঁকি কমানোর জন্য নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হতে পারে।
অধ্যাপক ডা· এম এ সামাদ
কিডনি রোগ ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ০৪, ২০০৯
Leave a Reply