তিনি এমন একজন মানুষ যার স্নিগ্ধতায় বদলে গেছে এদেশের রূপচর্চার ধারণা। রূপচর্চাকে শৌখিনতা থেকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপে উপস্থাপনের অধিনায়ক তিনি। যাকে সবাই এক নামে জানে। তিনিই কানিজ আলমাস খান। কারো কারো কাছে প্রিয় কানিজ আপা কিংবা টুসি আপা। ১৯৬০ সালের ৪ মার্চ বন্দর নগরীতে তার জন্ম। পাঁচ বোন, তিন ভাইয়ের মধ্যে কানিজ ষষ্ঠ। পড়াশোনা করেছেন, সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজে। তারপর ইডেন মহিলা কলেজ থেকে নিয়েছেন স্নাতক ডিগ্রী। সৌন্দর্যের প্রতি সহজাত আগ্রহ আর পরিবারের উৎসাহে ১৯৯০ সালে গড়ে তোলেন ‘গ্ল্যামার’ নামের ছোট্ট একটা বিউটি পার্লার। সেটি তার কলাবাগানের বাড়িতে ২০০ স্কয়ার ফুট আয়তনের একটি রুমে। একমুঠো স্বপ্নবাজি রেখে এগিয়ে চলে পার্লারটি। অবশ্য এটি গড়তে মাইক্রো ক্রেডিট ইন্ডাস্ট্রিজ ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যান্ড সার্ভিসেস থেকে ঋণ নিতে হয় দুই লাখ টাকা। তখন কর্মীসংখ্যা মাত্র ৯ জন। মানুষের ভালোবাসা আর ক্রমবর্ধমান চাহিদা মূল্যায়ন করে ’৯৮ সালে তার প্রতিষ্ঠানের পরিধি বাড়ে। নতুন নামে ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে ৩ হাজার ৮শ’ স্কয়ার ফুটের বৃহৎ পরিসরে গড়ে তোলা হয় বিউটি স্যালন ‘পারসোনা’। এসময় তার কর্মীর সংখ্যা ১২জন। ’০২ সালে যা ২০জনে দাঁড়ায়। তারপর শুধুই সামনে এগিয়ে চলার গল্প। কানিজ আলমাস খানের বিশ্বমানের মেকওভার ও দক্ষ নেতৃত্বে দিনে দিনে বাড়তে থাকে এর পরিধি। বাড়ে এর সেবার সংখ্যা ও মান। ’০৪ সালে বিউটি ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন চমক নিয়ে আসে পারসোনা। হেয়ার স্পেশালিস্ট জায়েদ হাবিব ও পারসোনার যৌথ প্রয়াস হিসেবে গুলশান-২-এ গড়ে ওঠে হাবিব আপারসোনা (বর্তমানে পারসোনা ও পারসোনা অ্যাডামস)। ’০৫ সালের আগস্টে পারসোনা পরিবারে আসে নতুন অতিথি। দেশের ফ্যাশন ও বিউটি ইন্ডাস্ট্রির দূত হিসেবে আবির্ভূত হয় ম্যাগাজিন ক্যানভাস। একই বছর ৩০ সেপ্টেম্বর ১১হাজার স্কয়ার ফুটের বিস্তৃত জায়গা নিয়ে ধানমন্ডি ২৭ নম্বরের সুবাস্তু জেনিম প্লাজায় পারসোনা আসে নতুন রূপে। এক্সিকিউটিভ, ম্যানেজার, উপদেষ্টা ও সার্ভিস প্রোভাইডারসহ পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২শ’ জনে। একই সঙ্গে স্যালন লাগোয়া গড়ে তোলা হয় স্টুডিও পারসোনা। ’০৭ সালের ১৬ মার্চ পথ চলতে শুরু করে প্রিং স্পা। একই বছর নারীর নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্যের জন্য গড়ে তোলা হয় আন্তর্জাতিক মানের জিম পারসোনা হেলথ। ’০৮ সালের জানুয়ারিতে গুলশান-১ এ যুক্ত হয় পারসোনার আরো একটি আউটলেট। বছরের ৭ মার্চ শুরু হয় পারসোনা ইন্সটিটিউট অব বিউটি অ্যান্ড লাইফস্টাইল-এর যাত্রা। মিরপুরবাসীকে আধুনিক রূপচর্চার আওতায় নিয়ে আসতে মিরপুর-১১ নম্বরে আউটলেটের দরজা খোলা হয় ’০৮-এর ২২ সেপ্টেম্বর। ’১০-এ এসে প্রায় মহিরুহে পরিণত হয় পারসোনা। ৪টি আউটলেটে ১২শ’ জনের বিশাল কর্মী দল। যার শতকরা ৯৯ জনই আবার নারী। বাঙালি ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের যৌথ আবাস পারসোনা। আর এই পরিবারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন পারসোনার ম্যানেজিং ডিরেক্টর কানিজ আলমাস খান। যিনি একই সঙ্গে সম্পাদনা করছেন দেশের খ্যাতনামা ফ্যাশন, বিউটি ও লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন ‘ক্যানভাস’। অন্যদিকে অধ্যক্ষ হিসেবে রয়েছেন পারসোনা ইন্সটিটিউট অব বিউটি অ্যান্ড লাইফস্টাইল-এ।
পেশাগত জীবনে তিনি রূপচর্চা বিষয়ক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন কোলকাতা ও মুম্বাই থেকে। কাজে উৎসাহ পেয়েছেন স্বামী ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হোসাইন নাসরাত আলী খান, একমাত্র মেয়ে দিশাসহ নিকটজন অনেকের কাছ থেকেই। শুভানুধ্যায়ীদের ভালবাসা তার প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেছে সব সময়। তাই শ্রমের ঘাম পায়ে ফেলে সামনে এগিয়ে যেতে কখনো কসুর করেননি এই সেলিব্রিটি বিউটিশিয়ান। দেশের নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে অর্থনীতিকে সাহায্য করার অনন্য যে প্রয়াস পারসোনা’র মাধ্যমে তিনি পেয়েছেন, তা নিঃসন্দেহে দৃষ্টান্তমূলক। অন্য নারীর জন্যও তা অনুসরণযোগ্য। কাজের স্বীকৃতস্বরূপ কানিজ আলমাস খান ’০৯ সালে পেয়েছেন স্ট্যান্ডার্ড চ্যাটার্ড-উইমেন অব ইকনোমিকস কোর্স-এর সম্মাননা। যে সৌভাগ্য প্রতিবছর বিশ্বের চারজন নারীর হয়ে থাকে। একই বছর তিনি পেয়েছেন ওয়ার্ল্ড ব্র্যান্ড লিডারশীপ অ্যাওয়ার্ড। এছাড়া নিয়মিত অন্যান্য স্বীকৃতিও তার শোকেসের শোভা দিনে দিনে বৃদ্ধি করে চলেছে। সরকারের আমন্ত্রণে’০৯ সালে তিনি সারদা পুলিশ একাডেমীতে পুশি অফিসারদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন একজন মানুষের সহজাত সৌন্দর্য ও ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তোলার কৌশল নিয়ে। পারসোনাকে কেবল সৌন্দর্য সেবাতেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়নি এই বারো বছরে, নানা সেবামূলক কর্মকান্ডের সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে পারসোনা’র নাম। এসিড সন্ত্রাস নির্মূল ও এসিডদগ্ধদের জন্যও পাশে দাঁড়িয়েছে পারসোনা। অ্যাকশন এইড, ড্যাবস, অপরাজেয় বাংলা, ডাব্লিউভিএ, বিএনডাব্লিউএনএসহ বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়নমূলক সংস্থাকে সঙ্গে নিয়ে পারসোনা ছায়া হয়ে দাঁড়িয়েছে সমাজের পিছিয়ে নারীর পাশে। এভাবেই পারসোনা কাটিয়েছে তার গৌরবময় ১২টি বছর। তাই শুভেচ্ছা পারসোনা’কে, শুভেচ্ছা কানিজ আলমাস খান’কে।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, মার্চ ০৯, ২০১০
Leave a Reply