দিনে একটু ঘুম কেবল ছোটদের জীবন-অভ্যাস হবে কেন? বিজ্ঞানীরা বলেন, সঠিক সময়ে একটু দিবানিদ্রা উজ্জীবিত করে শরীর ও মন। এই দিবানিদ্রাটুকু নিলে শরীর-মন বেশ সজাগ হয়, মন-মেজাজ হয় চনমনে, স্মৃতিশক্তিও হয় উন্নত।
নিরক্ষীয় অঞ্চলের উষ্ণ জলবায়ুতে লোকজনের মাধ্যাহ্নিক নিদ্রার চল রয়েছে। এতে তাদের উপকারও হয়।
গবেষকেরা দেখেছেন, মাধ্যাহ্নিক নিদ্রার চর্চা যেসব দেশে রয়েছে, সেখানকার লোকজনের হৃদরোগজনিত মৃত্যু অনেক কম হয়। তাপদগ্ধ দিনের গরম, আহার-এসব বিকেলে আনে ঘুমের আবেশ।
তবে আমাদের দেহের নিদ্রাচক্রে এমন কিছু আছে, যাতে এই দুপুরের ঘুম হয়ে পড়ে অতি প্রয়োজন। আমরা প্রতিদিনের নিদ্রা-জাগরণচক্রের মধ্য দিয়ে যখন যেতে থাকি, তখন এনার্জির তুঙ্গে উঠি, আবার নিচে নামি।
অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর মতো মানুষও দুটো শক্তিশালী নিদ্রার আঘাতে ধরাশায়ী হয়-রাত দুইটা থেকে চারটার মধ্যে এবং শেষ দুপুর একটা থেকে বিকেল তিনটার মধ্যে। দিনের এ সময় হলো ঢুলুঢুলু হওয়ার সময়।
পাঁচটি স্পষ্ট ধাপ পেরিয়ে চলে নিদ্রা। আট ঘণ্টা সময় পুরো না ঘুমিয়েও দিবানিদ্রা সামান্য সময় নিলেও শরীরের হিত হয়, মন প্রফুল্ল হয়। তবে মনে রাখা প্রয়োজন, দিবানিদ্রা কিন্তু পূর্ণরাতের সুনিদ্রার বিকল্প নয়। রাতে কম ঘুমিয়ে বা না ঘুমিয়ে দিবানিদ্রা নেওয়া মোটেও স্বাস্থ্যকর নয়।
ধাপ-১: প্রথম ধাপ হলো নিদ্রার প্রথম ৫-১০ মিনিটের ঘুম। চোখ তখন বুজে আসে, আমরা তন্দ্রায় হই আচ্ছন্ন। এমন সময় কেউ যদি জাগায়, তখন হয়তো জেগে উঠে বলবেন, ‘আমি কি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম?’
ধাপ-২: ঘুমের ২০-৩০ মিনিট, এমন সময় গভীর নিদ্রার প্রস্তুতি। এই ধাপে হৃৎস্পন্দন ধীর হয়ে আসে, দেহতাপ হ্রাস পায়, পেশিও ক্রমে ক্রমে শিথিল হতে থাকে। এই সময়ে পৌঁছে যাবেন জোরালো ঘুমের তুঙ্গে। ৩০ মিনিটের ‘ভাতঘুমে’ শক্তির উত্থান ঘটে, মনোযোগও বাড়ে, বিকেলের শেষ বেলায় এ দুটো বড় প্রয়োজন, নয়?
ধাপ-৩-৪: ঘুম যদি ৪৫ মিনিট পর্যন্ত পৌঁছায়, তাহলে ভাসতে থাকবেন ধীর তরঙ্গ নিদ্রায়। এই গভীর আচ্ছন্ন করা ঘুম ্নৃতিকে জোরালো করে, সংবাদতথ্যকে ্নরণ রাখা এবং একে ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা হলো ডিক্লেরেটিভ মেমোরি। তবে এই গভীরতর নিদ্রা থেকে উঠলে ঝাপসা, বেতাল মেঘের জালে জড়িয়ে পড়বেন, যা থেকে বেরোনো কঠিন। ঘুমের এই নিশ্চল অবস্থাকে এড়াতে চাইলে এ ধরনের গভীর দিবানিদ্রা শরীর অসুস্থ হলে বা বিশ্রামের খুব প্রয়োজনের সময়ের জন্য রেখে দেওয়া ভালো।
ধাপ-৫: ৯০ থেকে ১২০ মিনিটের ঘুমে ঢলে পড়লে চলে যাবেন স্বপ্নের রাজ্যে, আর দ্রুত আঁখি সঞ্চালনের অবস্থায়। হৃদ্ঘাতহার এবং শ্বাসহার আবার যাবে বেড়ে। এ ধরনের ‘মেগা ঘুম’ হারানো ঘুম পূরণ করে, ্নৃতিও উন্নত করে।
নটা-পাঁচটা অফিস-জীবনে দিবানিদ্রার সময় করে নেওয়া কঠিন। বিদেশে কোনো কোনো দেশের অফিসে মাধ্যাহ্নিক নিদ্রার প্রশ্রয় দেওয়ার ব্যবস্থা আছে, দুপুরে আহারের পর ্লান আলোয় চোখ বুজে থাকার জন্য আলাদা ঘরও নাকি আছে। নিদ্রাবান্ধব এবং পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থা বটে!
দিবানিদ্রার জন্য টিপস
— ভাতঘুম দেব, এ আর এমনকি। কিন্তু অনেকে তা চিন্তাও করতে পারবে না যে এ কাজ অত সহজ নয় কখনো কখনো।
— দিবানিদ্রার সময় কতটুকু হবে? অল্প সময় হলেই ভালো। এক ঘণ্টার বেশি সময় দিবানিদ্রা গেলে জেগে ওঠা কঠিন হবে এবং দিনের কাজ ধরাও কঠিন হবে।
— শ্রেষ্ঠ অবস্থান কী হবে? পাশ ফিরে শুলেই ভালো।
— তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হওয়ার পরিবেশ কেমন হবে? এমন এক স্থান বেছে নিতে হবে, যা আধো আলো-আধো ছায়া ঘর। নিরাপদ, নীরব, একটু উষ্ণও বটে।
তবে এত উষ্ণ নয় যে গভীর ঘুমে ঢলে পড়েন। ব্যবহার করা যেতে পারে ঘুম-মুখোশ। এতে পরিবেশ আঁধারও হলো, সামান্য চাপ পড়ল, যাতে চোখের চারপাশের টানটান পেশি আলগা হয়।
— মনের অবস্থা-দিবানিদ্রার ইচ্ছা তো থাকতে হবে, ‘আমি ২০ মিনিট দিবানিদ্রা নিয়ে শিথিল হব।’ কিছুক্ষণের জন্য নিজের ভাবনাকে বিযুক্ত করা, গভীর শ্বাস নেওয়া, ধীরস্থিরভাবে। এভাবেই রচনা করা যেতে পারে সুনিদ্রা স্বল্পক্ষণের। এমন ‘ভাতঘুম’ মন্দ নয়।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস
বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ০৪, ২০০৯
Leave a Reply