গ্লুকোমা কী
এটা চোখের এমন একটি রোগ, যাতে চোখের চাপ বেড়ে গিয়ে চোখের পেছনের স্মায়ু অকার্যকর হয়ে ধীরে ধীরে চোখের দৃষ্টি চলে যায়। গ্লুকোমা হলো অনিবারণযোগ্য অন্ধত্বের অন্যতম প্রধান কারণ।
কাদের হয়
যেকোনো বয়সে এটি হতে পারে। জন্মের সময় বেশ বড় চোখ এবং উচ্চ চক্ষুচাপ নিয়ে জন্মালে একে কনজেনিটাল গ্লুকোমা বা জন্মগত উচ্চ চক্ষুচাপ বলে। তরুণ বয়সেও এ রোগ হতে পারে, একে বলে জুভেনাইল গ্লুকোমা। বেশির ভাগ গ্লুকোমা রোগ ৪০ বছরের পরে হয়। এদের প্রাথমিক গ্লুকোমা বলে।
এ ছাড়া পারিবারিকভাবে যাদের এ রোগ আছে, যারা মাইনাস পাওয়ার চশমা পরেন, যাদের ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ আছে, তাদের মধ্যে এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।
কেন হয়
বেশি বয়সজনিত চোখের গঠনে পরিবর্তন, জন্মগত গঠনের ত্রুটি, আঘাত, চোখ লাল হওয়া, ডায়াবেটিসজনিত চোখের রক্তহীনতা, অনিয়ন্ত্রিত স্টেরয়েড বা হরমোন থেরাপি, ছানি পেকে যাওয়া ইত্যাদি কারণে গ্লুকোমা হতে পারে।
উপসর্গ
বিভিন্ন প্রকারের উপসর্গ নিয়ে রোগীরা ডাক্তারের কাছে আসতে পারে। হঠাৎ করে এক চোখে প্রচণ্ড ব্যথা হয়ে দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া, এর সঙ্গে প্রচণ্ড মাথাব্যথা ও বমি বমি ভাব হতে পারে।
আবার সব সময় চোখে ও মাথায় হালকা ব্যথা (বিশেষ করে কম আলোতে) এবং আস্তে আস্তে দৃষ্টিশক্তি কমে যেতে পারে। অন্যদিকে ব্যথা ছাড়াই উভয় চোখের দৃষ্টিশক্তি ধীরে ধীরে কমে যাওয়া এবং চশমার পাওয়ার পরিবর্তন নিয়েও রোগীরা ডাক্তারের কাছে আসে। মাঝেমধ্যে দৃষ্টিসীমানার যেকোনো এক পাশে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া, ছানি পেকে চোখ লাল হওয়া ইত্যাদিও এ রোগের উপসর্গ হতে পারে। জন্মগত বড় চোখ, চোখ থেকে পানি পড়া এবং আলোতে চোখ বন্ধ করে ফেলা জন্মগত গ্লুকোমার লক্ষণ হতে পারে।
রোগ নির্ণয়
রোগীর ইতিহাস এবং বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে গ্লুকোমা রোগ নির্ণয় সম্ভব। এর মধ্যে দৃষ্টিশক্তি পরীক্ষা (ভিসুয়াল এশুইটি), দৃষ্টিসীমানা পরীক্ষা (ভিজ্যুয়াল ফিল্ড), চোখের চাপ পরীক্ষা (ইন্ট্রাঅকুলার প্রেসার), গনিয়স কপি বা চোখের কোণ পরীক্ষা এবং অফথালমোসকপি বা চোখের স্মায়ু পরীক্ষা বেশি গুরুত্ব বহন করে। স্বাভাবিক চোখের চাপ সাধারণত (১০-২১) মি·মি· মার্কারি। অস্বাভাবিক চোখের চাপ থাকলে সব পরীক্ষার মাধ্যমে গ্লুকোমা শনাক্ত করে দ্রুত চিকিৎসা নিতে হবে।
কীভাবে প্রতিরোধ করবেন
— পারিবারিকভাবে যাদের গ্লুকোমা রোগের ইতিহাস আছে, তাদের নিয়মিত চক্ষু রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে চোখ পরীক্ষা করতে হবে।
— অল্প আলোতে কারও চোখে ও মাথায় ব্যথা হলে ডাক্তারের পরামর্শ প্রয়োজন।
— চোখে ছানি পড়লে তা পেকে যাওয়ার আগে অপারেশন করিয়ে নেওয়া ভালো।
— চোখে প্রদাহ হলে তা থেকে গ্লুকোমা হওয়ার আগে চিকিৎসা করানো প্রয়োজন।
— চোখে আঘাতের পর দেরি না করে চিকিৎসা করাবেন।
— স্টেরয়েড বা হরমোন থেরাপি যাঁরা নেন তাঁরা নিয়মিতভাবে অন্তত তিন-চার মাস অন্তর চোখ পরীক্ষা করাবেন।
— আধুনিক যন্ত্রপাতিসমৃদ্ধ কোনো হাসপাতালে অভিজ্ঞ চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে চোখের ছানি অপারেশনসহ বিভিন্ন অপারেশন করালে অপারেশন-পরবর্তী গ্লুকোমা রোগের ঝুঁকি রোধ করা যায়।
— পরিশেষে জীবনযাত্রার অভ্যাস পরিবর্তন, যেমন-পরিমিত খাদ্যাভাস, লবণজাতীয় খাবার বর্জনের মাধ্যমে তথা ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে গ্লুকোমা রোগের ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।
চিকিৎসা
ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ সেবনের মাধ্যমে গ্লুকোমা রোগ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। চোখের চাপ স্বাভাবিকের চেয়ে সামান্য বেশি হলে একটি ওষুধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। চোখের চাপ যদি খুব বেশি থাকে অথবা একটি ওষুধে যদি নিয়ন্ত্রণ না হয়, তাহলে দুটি অথবা তিনটি ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে।
যদি দু-তিনটি ওষুধে চোখের চাপ নিয়ন্ত্রণে না থাকে এবং আস্তে আস্তে দৃষ্টিশক্তি লোপ পেতে থাকে, সে ক্ষেত্রে ট্রাবেকুলেকটমি নামক অপারেশনের মাধ্যমে গ্লুকোমা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। বাচ্চাদের গ্লুকোমা ওষুধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। সে ক্ষেত্রে অপারেশনের প্রয়োজন পড়ে।
লেসার থেরাপির মাধ্যমে গ্লুকোমার চিকিৎসা করা সম্ভব। নিয়মিত ওষুধ ব্যবহার করলে গ্লুকোমা রোগ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। যেহেতু এই রোগে স্মায়ুর পরিবর্তন হয়, সেহেতু পরবর্তী সময়ে আরও বেশি ক্ষতি থেকে চোখকে রক্ষা করাই হলো গ্লুকোমা চিকিৎসার উদ্দেশ্য।
ডা· শামস মোহাম্মদ নোমান
জুনিয়র কনসালটেন্ট
চট্টগ্রাম চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ০৪, ২০০৯
Leave a Reply