পিছিয়ে থাকার সময় অনেক আগেই শেষ হয়েছে। তাইতো আমাদের নারীরা আজ সাফল্যের পতাকা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। আর এই এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে রয়েছে অনেক শ্রমের গল্প। বিশ্ব নারী দিবসকে সামনে রেখে আমাদের শোবিজ জগতের খ্যাতিমান কয়েকজন নারীর সফল হয়ে ওঠার গল্প নিয়ে এবারের মূল ফিচার লিখেছেন রকিব হোসেন।
নারী শব্দটি উচ্চারণ করতেই আমরা সবাই নাড়ির টান অনুভব করি। নারী মানে একজন মা, কন্যা, বোন আরো অনেক সম্পর্কের বন্ধন। আর এই সম্পর্কের মাঝে আছে অনেক মধুরতা, আবেগের মাখামাখি আরো আছে আনন্দ, সুখের অনেক কাব্য। এক সময় নারী অভিধানে অবহেলিত, অসহায়ত্ব এই শব্দগুলো খুব মাথা উঁচু করে দাঁড়ালেও এখন আর সেখানে এই শব্দগুলো খুব দুর্বল চেহারা নিয়ে তাকিয়ে থাকে। সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশের নারীরাও নিজেদের সাফল্যের গল্প রচনা করেছেন অনেক বন্ধুর পথ অতিক্রম করে। তেমনি আমাদের শোবিজ জগতের নারীদের সাফল্য গাঁথাও চোখে পড়ে বড় করে। এই জগতের বাসিন্দাদের অনেকেই আজ নিজের কর্ম দিয়ে নতুন প্রজন্মের মাঝে আদর্শ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাদের মিডিয়ায় আলোচিত নারীদের মধ্যে প্রথমেই বলতে হয় খ্যাতিমান চলচ্চিত্র অভিনেত্রী ও পরিচালক কবরী’র কথা। বরেণ্য পরিচালক সুভাষ দত্তের হাত ধরে ১৯৬৪ সালে চলচ্চিত্রে আসেন মিষ্টি মেয়ে কবরী। প্রথম ছবি ‘সুতরাংম্বএ তার অভিনয় দর্শক মনে আলোড়ন তোলে। এরপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। শুধু সাফল্যের সঙ্গে সামনে এগিয়েছেন তিনি। এক সময় নায়ক রাজ-রাজ্জাকের সঙ্গে জুটি হয়ে কাজ করে তিনি তৈরি করেছেন সাফল্যের নতুন এক ইতিহাস। শতাধিক ছবিতে অভিনয় করে কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। তার উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে রয়েছে- ময়নামতি, বধূ বিদায়, কখগঘঙ, অধিকার, সারেং বৌ, দ্বীপ নেভে নাই, আবির্ভাব, দুই জীবন, অনির্বাণ, স্মৃতিটুকু থাক, সুজন সখি। তার পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র আয়না একটি বিশেষ শ্রেণীর দর্শকদের মধ্যে সাড়া জাগিয়েছে। চলচ্চিত্র এবং টিভি নাটক দুই মাধ্যমেই তিনি কাজ করছেন সাফল্যের সাথে। অবশেষে জনপ্রতিনিধি হিসেবে সাফল্যকে মুঠোবন্দী করেছেন তিনি।
ষাটের দশকের শুরুতে এক্সট্রা শিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্রে কাজ করেছিলেন শাবানা। এভাবে কয়েকবছর কাটানোর পর ১৯৬৭ সালে চকোরি ছবিতে তার সুযোগ হয় নায়িকা চরিত্রে কাজ করার। প্রথম ছবিতেই সাফল্যের বাতায়ন খুলে দেন শাবানা। তারপর ভাত দে, অবুঝমন, মাটির ঘর, মধুমিলন, সকাল সন্ধ্যা, সখিনার যুদ্ধ, সখি তুমি কার, অস্বীকার, মরণের পরে, পিতামাতা সন্তান প্রভৃতি ছবিতে শাবানা নিজের অভিনয় প্রতিভাকে তুলে ধরেছেন শক্ত করে। তিনি বলতেন, এফডিসি তার দ্বিতীয় সংসার।
শুধু দেশে নয়, চিত্র নায়িকা ববিতার খ্যাতি ছড়িয়ে আছে বিদেশেও। জহির রায়হানের হাত ধরেই তার অভিনয় জীবন শুরু হয়। প্রথম ছবিতে তিনি কিশোরী চরিত্রে কাজ করেছেন। নায়িকা হয়েছেন দ্বিতীয় ছবি ‘শেষ পর্যন্ত’এ। আর এ ছবির মাধ্যমেই তার সাফল্যের যাত্রা শুরু। ববিতা অভিনীত দর্শকপ্রিয় চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে অস্বনী সংকেত, সুন্দরী, কসাই, গোলাপী এখন ট্রেনে, স্বরলিপি, টাকা আনা পাই, নয়ন মনি ইত্যাদি। অভিনয় স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি পেয়েছেন দেশে-বিদেশে অনেক পুরস্কার। ববিতা বলেন, ‘আমার যেকোনো কাজের সিদ্ধান্ত আমি নিজেই নিতাম। সব সময় চেষ্টা করেছি যে কাজটি করছি তা সততার সঙ্গে করতে। আমি যা কিছু পেয়েছি তার পেছনে ছিল আমার ডেডিকেশন, ডিসিপ্লিন, ডিটারমিনেশন। আমি মনে করি জীবনে সাফল্য পেতে হলে এগুলোর খুবই প্রয়োজন।’ কবরী, শাবানা ও ববিতার যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে মডেলিং দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করে ছিলেন মৌসুমী। এরপর প্রথম ছবি কেয়ামত থেকে কেয়ামত-এ অভিনয় করে রাতারাতি তারকা বনে যান তিনি। তার অভিনীত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে- দেন মোহর, স্নেহ, বিদ্রোহী বধূ, মেঘলা আকাশ, গৃহ বধূ, খায়রুন সুন্দরী।’ চলচ্চিত্রের পাশাপাশি মৌসুমী কাজ করেছেন টিভি নাটকেও। এখানেও সাফল্য তার পিছু নিয়েছে। চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও মৌসুমী পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। মৌসুমী বলেন, ‘আমি একজন আত্মবিশ্বাসী মানুষ। আর এই আত্মবিশ্বাসে ভর করেই কাজ করেছি। পাশাপাশি এর সাথে ছিল মেধা ও পরিশ্রম। সংসারও সামলিয়েছি সফলতার সঙ্গে। এ কারণে ব্যক্তিজীবনে আমি একজন সুখী মানুষ। আজকের এ অবস্থানে এসে আমার যে উপলব্ধি হয়েছে তা হলো একজন নারী চাইলেই সবকিছু ঠিক রেখে সাফল্যের পথে এগিয়ে যেতে পারে।
চলচ্চিত্র তারকাদের মতো আমাদের নাটকের শিল্পীরাও সাফল্য দিয়ে নিজেদের নির্মাণ করেছেন নিপুণভাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন বড় ভাই মুনির চৌধুরীর উৎসাহে মঞ্চ নাটকের অভিনয় শুরু করেন ফেরদৌসী মজুমদার। তিনি বিটিভির প্রথম নাটক ‘একতলা-দোতলা’র অভিনেত্রী। তার অভিনীত মঞ্চ নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- কোকিলারা (একক নাটক), পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, ম্যাকবেথ, ওথেলো, মেরাজ ফকিরের মা, দুই বোন প্রভৃতি। টিভি নাটকের মধ্যে রাহু, সংশপ্তক, আমি তুমি সে, আশ্রয়, বরফ গলা নদী, অকূল দরিয়ার বাঁক ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছেন। বেশকটি চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন ফেরদৌসী মজুমদার। এরমধ্যে দমকা, মায়ের অধিকার, বিহঙ্গ উল্লেখযোগ্য। সংসার ও কর্মজীবনে সফল মানুষ ফেরদৌসী মজুমদার বলেন, ‘সংসার ও কর্মজীবন দু’ মাধ্যমের কাজের প্রতি আমি সবসময় সচেতন ছিলাম। একটির কারণে অন্যটির যেন কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকে আমি সজাগ থেকেছি। আমি আজ যে অবস্থানে এসেছি তা সম্ভব হয়েছে কাজের প্রতি নিষ্ঠা, সততা, পেশাদারিত্ব ও ভালোবাসার কারণে। কাজের প্রতি কখনো বিরক্তি হয় নি। সকালে ঘুম থেকে উঠে কাপড় ধুয়েছি, স্কুলে গিয়েছি এরপরও আবার শুটিং করেছি। ঘুমিয়েছি চার-পাঁচ ঘণ্টা। মনপ্রাণ উজাড় করে কাজ করেছি। এজন্য প্রশংসিতও হয়েছি। আমার কোনো আক্ষেপ নেই।’ জহির রায়হানের বরফ গলা নদী নাটকের মাধ্যমেই অভিনয় জীবন শুরু করেন সুর্বনা মুস্তাফা। প্রথম নাটকেই মেধার বিচ্ছুরণ ঘটান তিনি। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য টিভি নাটকের মধ্যে রয়েছে- বরফ গলা নদী, চেহারা, ইডিয়ট, কূল নাই কিনার নাই, তবুও জীবন, আকাশ কুসুম, কোথাও কেউ নেই, আজ রবিবার, সংশপ্তক ইত্যাদি। টিভি নাটকের পাশাপাশি মঞ্চেও সুবর্ণা মুস্তাফা তার অভিনয় দক্ষতা মেলে ধরেছেন। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য মঞ্চ নাটকগুলো হলো- শকুন্তলা, মুনতাসীর ফ্যান্টাসী, কীত্তনখোলা, হাত হদাই, বন পাংশুল, যৈবতী কন্যার মন প্রভৃতি। এছাড়া চলচ্চিত্রেও নিজেকে প্রমাণ করেছেন সুবর্ণা মুস্তাফা। ঘুড্ডি, লাল সবুজের পালা, নতুন বউ, শঙ্খনীল কারাগার, নয়নের আলো ইত্যাদি ছবিতে আমরা পেয়েছি ভিন্ন ভিন্ন সুর্বণা মুস্তাফাকে।
গান দিয়ে দেশীয় নারী শিল্পীদের সফলতার গল্পটা রচনা করার ইতিহাস অনেক পুরনো। তখন বয়স নয়। এ বয়সেই প্রথম প্লেব্যাকে কণ্ঠ দেন সাবিনা ইয়াসমিন। এরপর তিনি একচেটিয়া কাজ করেছেন দেশীয় প্লেব্যাকে। সুরের ইন্দ্রজালে মাতিয়েছেন দেশ-বিদেশের কোটি কোটি দর্শক। তার কণ্ঠে দেশের গান পেয়েছে নতুন মাত্রা। একুশে পদক, স্বাধীনতা পদকসহ একাধিক জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন এই গুণী শিল্পী। সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, গানটাকে সব সময়ই সাধনার বিষয় বলে জেনেছি। কাজ করেছি শতভাগ আন্তরিকতা নিয়ে। এ কারণে ভালোবাসা পেয়েছি কোটি শ্রোতার। কেউ যদি শতভাগ সততার সঙ্গে কাজ করে, সাফল্য তার মুঠোবন্দী হতে বাধ্য।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, মার্চ ০৪, ২০১০
Leave a Reply