‘ইয়াবা’ নিয়ে অনেক আলোচনা চারদিকে। এটি আসলে কী? আমি প্রথম আলো মাদকবিরোধী আন্দোলনের একজন সক্রিয় সদস্য ও উপদেষ্টা । প্রায়ই ভাবি, আমাদের একটা বই থাকা দরকার বা একটা ওয়েবসাইট, যেখানে সব ধরনের মাদকের কুফল সম্পর্কে তথ্য থাকবে। ব্যস্ততা বা আলসেমির কারণে এটা এখনো হয়ে ওঠেনি। এ লেখাটা দিয়েই শুরু হোক। ‘ইয়াবা’ বলে দুটো জায়গা আছে পৃথিবীতে একটা লাগোসে, আরেকটা বুরকিনা ফাসোতে।
এ ড্রাগের নাম কিন্তু সেসব জায়গা থেকে আসেনি। থাইল্যান্ডে এ ড্রাগের ব্যবহার ও উৎপাদন বেশি বলে এর নাম থাই ভাষায় ‘ইয়াবা’। এর মানে ক্রেজি মেডিসিন বা পাগলা ওষুধ। অনেকে একে বলে নাজি স্পিড বা শুধু স্পিড। ১৯৭০ সালে এ ওষুধের মূল উপাদান থাইল্যান্ড এবং সারা বিশ্বে নিষিদ্ধ করা হলেও থাইল্যান্ডের ট্রাকচালকদের মধ্যে এর বহুল ব্যবহার ছিল। কারণ ইয়াবা খেলে ঘুম আসে না, রাতভর ট্রাক চালানো যায়। কিছু ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর সবাই টের পেল যে রাতভর ট্রাক চলে বটে, তবে তা পথে নয়, চলে খানাখন্দ আর ব্রিজ ভেঙে নদীতে। একসময় থাইল্যান্ডে এ ড্রাগ পেট্রলপাম্পে বিক্রি হতো।
ইয়াবার মূল উপাদান মেথ্যামফিটামিন। সঙ্গে থাকে উত্তেজক পদার্থ ক্যাফিন। ২৫ থেকে ৩৫ মিলিগ্রাম মেথ্যামফিটামিনের সঙ্গে ৪৫ থেকে ৬৫ মিলিগ্রাম ক্যাফিন মিশিয়ে তৈরি এ ট্যাবলেটের রং সাধারণত সবুজ বা লালচে কমলা হয়ে থাকে। এর নানা রকম ফ্লেভার আছে। আঙ্গুর, কমলা বা ভ্যানিলার স্বাদে একে অনেকে ক্যান্ডি বলে ভুল করবে। এ কারণে এগুলো সহজে পরিবহন ও লুকিয়ে রাখা যায়। এর আকৃতি ড্রিঙ্কিং স্ট্রর ছিদ্রের সমান। স্বাদ-গন্ধ থাকার ফলে বিক্রেতারা সহজেই তরুণ-তরুণীদের এর ব্যাপারে আকৃষ্ট করতে পারে এবং তারা একে ক্ষতিকারক মনে করে না। না করারই কথা। লজেন্স ভেবে অনেকে এটাকে সহজেই খেয়ে নেয়।
এবার জানা যাক মেথ্যামফিটামিনের ইতিহাস। ১৯১৯ সালে জাপানে সর্দি আর নাক বন্ধের ওষুধ হিসেবে এটি ব্যবহার করা হতো। একসময় মেদভঁুড়ি কমানোর জন্যও এ জিনিস ব্যবহার করা হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান, ব্রিটেন, জার্মানি ও আমেরিকায় সেনাবাহিনীর সদস্যরা জেগে থাকতে এবং ক্লান্তি দূর করতে এটা খেত। যুদ্ধের পর এ ওষুধের বিশাল মিলিটারি স্টক ছড়িয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের হাতে। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত আমেরিকায় এ ড্রাগটা আইনসংগতভাবে তৈরি হতো। পরে ছাত্রছাত্রী, ট্রাকচালক ও অ্যাথলেটরা এর যথেচ্ছ ব্যবহার করতে থাকলে কুফল সম্পর্কে জানা যায়। ১৯৭০ সালে বিশ্বব্যাপী এটা নিষিদ্ধ করা হয়।
এখন এ ড্রাগের সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয় মিয়ানমারে এবং এর বিরাট বাজার হলো থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশ। আমেরিকাসহ পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোও এর ছোবলের বাইরে নেই। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোতেও এর ব্যবহার বাড়ছে দ্রুত। পার্টি ড্রাগ হিসেবে এর ব্যবহার হয় এবং একসট্যাসি নামের অন্য একটি ড্রাগের সস্তা বিকল্প হিসেবে এটি আমেরিকায় ড্রাগ অ্যাডিক্টদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছে।
ইয়াবা প্রধানত খায়। অনেকে এটা পাতলা অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল ব্যবহার করে তাপ দিয়ে পুড়িয়ে ধোঁয়া সেবন করে। বেশি আসক্তরা শিরাপথেও এটা নেয়।
ইয়াবার প্রচণ্ড উত্তেজক-ক্ষমতা আছে এবং তা অনেকক্ষণ থাকে বলে কোকেনের চেয়ে অ্যাডিক্টরা এটা বেশি পছন্দ করে। ইয়াবা খেলে সাময়িক আনন্দ ও উত্তেজনা, অনিদ্রা, খিটখিটে ভাব ও আগ্রাসী প্রবণতা বা মারামারি করার ইচ্ছা, ক্ষুধা কমে যাওয়া ও বমি ভাব, ঘাম, কান-মুখ লাল হয়ে যাওয়া এবং শারীরিক সঙ্গের ইচ্ছা বেড়ে যায়। তবে এ সবই অল্প কয়েক দিনের বিষয়। বাড়ে হূৎস্পন্দনের গতি, রক্তচাপ, শ্বাস-প্রশ্বাস এবং শরীরের তাপমাত্রা। মস্তিষ্কের সূক্ষ্ম রক্তনালিগুলোর ক্ষতি হতে থাকে এবং কারও কারও এগুলো ছিঁড়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে যায়। কিছুদিন পর থেকে ইয়াবাসেবীর হাত-পা কাঁপে, হ্যালুসিনেশন হয়, পাগলামি ভাব দেখা দেয়, প্যারানয়া হয়। হ্যালুসিনেশন হলে রোগী উল্টোপাল্টা দেখে, গায়েবি আওয়াজ শোনে। আর প্যারানয়াতে ভুগলে রোগী ভাবে, অনেকেই তার সঙ্গে শত্রুতা করছে। তারা অনেক সময় মারামারি ও সন্ত্রাস করতে পছন্দ করে। কারও কারও শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়, খিঁচুনি হয়। খিটখিটে ভাব, অহেতুক রাগারাগি, ভাঙচুর, নার্ভাসনেসে ভুগতে থাকে ইয়াবা আসক্ত ব্যক্তিরা।
স্ম্বরনশক্তি কমে যায়, সিদ্ধান্তহীনতা শুরু হয় এবং কারও কারও সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ দেখা দেয়। অনেকে পাগল হয়ে যায়। লেখাপড়ায় খারাপ হয়ে একসময় ডিপ্রেশন বা হতাশাজনিত নানা রকম অপরাধ প্রবণতা, এমনকি আত্মহত্যাও করে থাকে। হার্টের ভেতরে ইনফেকশন হয়ে বা মস্তিষ্কের রক্তনালি ছিঁড়ে অনেকে মারা যায়। অনেকে মরে রাস্তায় দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে। কেউ কেউ টানা সাত থেকে ১০ দিন জেগে থাকে, তারপর ড্রাগ ওভার ডোজেও মরে যায়।
দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা করলে ইয়াবার আসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তবে শারীরিক ক্ষতি পুরোপুরি সারানো সম্ভব নাও হতে পারে। তাই আসক্ত ব্যক্তিকে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে।
ইয়াবার বিস্তার রোধ করতে হলে চাই সামগ্রিক প্রতিরোধ। বন্ধ করতে হবে উৎপাদন ও পরিবহন। থাইল্যান্ড ও মিয়ানমার থেকে এর চোরাচালান আটকাতে হবে। পুল ক্লাব, লাউঞ্জ, বার, এন্টারটেইনমেন্ট ক্লাবগুলোতে কড়া নজরদারি রাখতে হবে। এটার ব্যবহার হয়ে থাকে হৈ-হুল্লোড় করা পার্টিপ্রেমী তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বেশি। ইয়াবার কুফল সম্পর্কে তাদের সচেতন করতে হবে। পার্টি করতে হলে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে এবং কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে জামিনদার হতে হবে যে এ পার্টিতে কোনো নিষিদ্ধ বস্তুর ব্যবহার ঘটবে না। অনেক অভিভাবক ছেলেমেয়েদের হাতে অনেক টাকা তুলে দেন, এটা বন্ধ করতে হবে। তাদের টাকা দিলে কোথায় খরচ করল তার হিসাব নিতে হবে। আর ড্রাগ ব্যবসায়ী ধরা পড়লে দ্রুত তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
উৎসঃ দৈনিক প্রথম আলো, ২৪ অক্টোবর ২০০৭
Leave a Reply