জীবনের আরেক নাম রক্ত। প্রতিবছর আমাদের দেশে দুই থেকে আড়াই লাখ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয় মুমূষু রোগীকে বাঁচাতে। এই রক্ত আমরা পেয়ে থাকি দাতার কাছ থেকে। রক্তের কোনো বিকল্প নেই। মানুষের জন্য মানুষই রক্তের একমাত্র জোগানদাতা।
রক্ত পরিসঞ্চালনের ইতিহাস অনেক পুরোনো। মেডিসিন যুগের বহু আগে থেকেই সভ্য সমাজ মনে করত, রক্ত হচ্ছে জীবনের উৎস। আদিবাসীদের মধ্যে এই ধারণা ছিল যে তাদের সবার রক্ত একই রকম।
তারা মানুষের ও জন্তুর রক্তের মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে বলে বিশ্বাস করত না। তখন রক্ত পরিসঞ্চালনের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতিও ছিল না। রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ায় এর অগ্রগতি ছিল সীমিত।
১৬৬৫ সালে ইংরেজ বিজ্ঞানী ডা· রিচার্ড লোয়ার (ফিজিওলজিস্ট) প্রথম রক্ত পরিসঞ্চালন করেন। ১৬৬৭ সালে ফরাসি বিজ্ঞানী জিন বয়েপটিস্ট ডেনিস প্রথম মানুষের মধ্যে রক্ত সঞ্চালন শুরু করেন। প্রথম তিনবার তিনি সফলতার সঙ্গে রক্ত পরিসঞ্চালন করেন। যখন ভেড়ার রক্ত মানুষের মধ্যে সঞ্চালনের প্রক্রিয়ায় এক মানসিক রোগী মারা যায়, তখন মানুষ খুন করার অপরাধে আদালত ওই বিজ্ঞানীকে দোষী সাব্যস্ত করেন। এতে পুরো ইউরোপে রক্ত পরিসঞ্চালন গবেষণা বন্ধ হয়ে যায় উনিশ শতক পর্যন্ত।
জেমস বান্ডেল নামে লন্ডনের এক ধাত্রীবিদ্যা-বিশেষজ্ঞ মৃত্যুপথযাত্রী প্রসূতিকে বাঁচাতে মানুষের রক্ত সরাসরি রোগীর দেহে সঞ্চালন করে তার জীবন রক্ষা করেন। এতে এটাই প্রমাণিত হয় যে মানুষের ও অন্যান্য প্রাণীর রক্ত আলাদা।
এর পরও অসুবিধা রয়েই গেল।
আর তা হচ্ছে হেমোলাইটিক ট্রান্সফিউশন রি-অ্যাকশন ও দাতার রক্ত খুব তাড়াতাড়ি জমাট বেঁধে যায়। উনিশ শতকে ল্যান্ড স্টেইনার এবিও ব্লাড গ্রুপের আবিষ্কারের ফলে ট্রান্সফিউশন রি-অ্যাকশন অনেকটাই কমে যায়। ১৯৩৯ সালে লেভিন ও স্টেটসন দেখলেন, এক প্রসূতি মৃত বাচ্চা প্রসব করার পর যখন তাঁর শরীরে স্বামীর রক্ত পরিসঞ্চালন করা হলো, তখন এতে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হলো। পরীক্ষা করে দেখা গেল, স্বামীর শরীরে যে অ্যান্টিবডি আছে, সেটা এবিও ব্লাড গ্রুপের ৮৫ শতাংশ রক্তকণিকা জমাট বাঁধার জন্য যথেষ্ট।
১৯৪০ সালে ল্যান্ড স্টেইনার ও উইনার এক পরীক্ষায় গিনিপিগ ও খরগোশের দেহে রেসাস বানরের রক্ত ঢুকিয়ে দেওয়ায় যে অ্যান্টিবডি তৈরি হলো, সেটা শুধু বানরের ও ৮৫ শতাংশ ইউরোপীয়র রক্ত জমাট বাঁধাতে সক্ষম। যাদের রক্ত জমাট বাঁধল, তারা পরে আরএইচ পজিটিভ ব্লাড গ্রুপ হিসেবে চিহ্নিত হলো; আর যাদের রক্ত জমাট বাঁধল না, তারা আরএইচ নেগেটিভ হিসেবে রয়ে গেল। আমাদের দেশে ৯৭ শতাংশ মানুষের রক্ত আরএইচ পজিটিভ এবং তিন শতাংশের আরএইচ নেগেটিভ। এই তিন শতাংশ নিয়ে আমাদের এত মাথাব্যথা কেন? এ জন্য যে এই তিন ভাগের অর্ধেক আবার নারী। আরএইচ নেগেটিভ মা যদি আরএইচ পজিটিভ সন্তান ধারণ করেন, তাঁর শরীরে ভ্রূনের শরীর থেকে লোহিত কণিকা প্লাসেন্টা বা গর্ভফুলের মাধ্যমে মায়ের শরীরে প্রবেশ করে অ্যান্টি-ডি নামের অ্যান্টিবডি তৈরি করে।
সেই অ্যান্টিবডি আবার গর্ভফুলের মাধ্যমে ভ্রূনের শরীরে ঢুকে হেমোলাইটিক রক্ত পরিসঞ্চালনের প্রতিক্রিয়া করে ভ্রূনকে মেরে ফেলে। পরে ওই মা যদি প্রথম থেকেই চিকিৎসা না নেন, তাহলে তিনি আর কোনো দিন জীবিত শিশুর জ্ন দিতে পারেন না।
যখন কোনো দুর্ঘটনা ঘটে রক্তের গ্রুপিং অথবা ক্রস ম্যাচিংয়ের সময় থাকে না, সে ক্ষেত্রে মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচানোর জন্য আমরা ও-নেগেটিভ রক্ত দিয়ে থাকি।
প্রয়োজনের তুলনায় রক্তের সরবরাহ খুবই কম। গ্রুপের নিরাপদ এক ব্যাগ রক্তের প্রয়োজনে ছুটতে হয় শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে, এক জেলা ছেড়ে অন্য জেলায়। প্রয়োজন যেহেতু যুক্তি মানে না, তাই রক্তদাতা অপরিচিত মানুষটিও তখন হয়ে যায় পরম আত্মীয়, স্বাজনরের চেনা।
নেগেটিভ গ্রুপের রক্তস্বল্পতার কারণে এখন সময় এসেছে এই গ্রুপের রক্তের দাতা তৈরি করার।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সচেতন করতে পারলে এ সমস্যা অনেকটাই দূর করা সম্ভব।
উৎসঃ দৈনিক প্রথম আলো, ৩১, অক্টোবর ২০০৭
লেখকঃ ডা· মাসুদা বেগম
সহযোগী অধ্যাপক, হেমাটোলজি বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।
Leave a Reply