ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম দীর্ঘদিন ধরে কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিষয়টি পড়াচ্ছেন। তিনি আপনার বিভিন্ন মানসিক সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন। আপনার সঠিক পরিচয় না দিতে চাইলে অন্য কোনো নাম ব্যবহার করুন। যে সমস্যার কথা আপনি ছাপতে চান না, তা লিখে পাঠাবেন না। খামের ওপর অবশ্যই ছুটির দিনে মনের জানালা কথাটি লিখবেন। —বি.স.
সমস্যা: পাঁচ মাস আগে আত্মহত্যার চেষ্টা করি। তখন ডাক্তার আমাকে মনোরোগ চিকিত্সকের কাছে যেতে বলেন। কিন্তু সমস্যার কারণে তা হয়ে ওঠেনি। আমি কাউকে আমার মনের কথাগুলো বলতে পারিনি। সবাই আমাকে খুবই খারাপ ভাবে। আমার দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে, আমি সবার বিরুদ্ধে শুধু শুধু অভিযোগ করি। আপনিই বলুন, আমার কী করা উচিত। দিন দিন আমার সমস্যার মাত্রা বাড়ছে, সারাক্ষণ একা একা থাকি, অল্পতে রেগে যাই। কিন্তু কারও সঙ্গে রাগ দেখাতে পারি না। আমাকে কেউই তেমন গুরুত্ব দেয় না।
তাহসান।
পরামর্শ: নিজের সমস্যার ব্যাপারে তোমার সচেতনতা সত্যি প্রশংসনীয়। অনেকের এ ধরনের সমস্যা রয়েছে। কিন্তু তারা সেটা বুঝতে পারছে না। মনে হচ্ছে, তোমার ‘মুড’-এর ওঠানামা খুব বেশি হচ্ছে। মাঝেমধ্যে তুমি খুব বিষণ্ন হয়ে পড়ছ বলে নিজের জন্য ক্ষতিকর কাজ করছ। তোমার মনে হচ্ছে, তোমাকে কেউ গুরুত্ব দেয় না। সে কারণেই তুমি তোমার মনের ভাব প্রকাশ করার ব্যাপারে উদ্যোগী হচ্ছ না। আগ্রাসী মনোভাবাপন্ন বা খুব বেশি অন্তর্মুখী মানুষ অন্যদের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করতে গিয়ে অসুবিধার সম্মুখীন হয়। আগ্রাসীরা নিজের অধিকারকে সব সময় বড় করে দেখে এবং অন্তর্মুখীরা অন্যদের অধিকারকে অগ্রাধিকার দিয়ে নিজেকে কষ্ট দেয়। সবচেয়ে ভালো হয়, যদি তুমি অন্যের ও নিজের অধিকারের প্রতি সম্মান রেখে খুব স্বাভাবিক মুডে নিজের ভাবনাগুলো প্রকাশ কর। এটি করা অত্যন্ত কঠিন তাতে সন্দেহ নেই। তবে যাদের প্রতি তোমার একটু কম অভিযোগ রয়েছে, তাদের সঙ্গে এভাবে আচরণ করার প্রক্রিয়াটি শুরু করতে পার। অন্যরা তোমাকে গুরুত্ব না দিলেও তুমি তোমার ইতিবাচক দিকগুলো বা ভালো গুণাবলির কথা মাথায় রেখে নিজেকে গুরুত্ব দিতে শুরু করো। জীবনটাকে একটি আশীর্বাদ হিসেবে দেখতে চেষ্টা করো। তবে তোমার বিষণ্নতা যেহেতু হচ্ছে, মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য সাহায্য নিতে তুমি বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় বা ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে গিয়ে মনোরোগ চিকিত্সকের কাছ থেকে সাইকোথেরাপি নিতে পার।
সমস্যা: আমার বয়স ২০। আমার কোনো ভাইবোন নেই। ছোটবেলা থেকে খুব আদরে বড় হয়েছি। চাওয়া মাত্রই সবকিছু পেয়েছি। ছাত্রী হিসেবেও সব সময় ভালো ছিলাম। ছোটবেলা থেকেই আমার রাগ খুব বেশি। কোনো কিছু আমার মনের মতো না হলে আমি মেঝেতে মাথা ঠুকতাম। মাত্র এক বছর বয়স থেকে। সাত-আট বছর বয়স থেকে এমন হয়নি। তবে কিছু দিন হলো আমার আবার একই রকম সমস্যা হচ্ছে। হঠাত্ কোনো কারণ ছাড়া রাগ হয়ে যায়। মনে হয় হাতের কাছে যা আছে ভেঙে ফেলি। অথবা আম্মুর সঙ্গে ঝগড়া করি, কিন্তু আম্মুর সঙ্গে ঝগড়া করলে আম্মু কষ্ট পাবে ভেবে নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করি। তখন কেমন হতাশাগ্রস্ত এবং নিজেকে পাগল মনে হয়। কিছুক্ষণ পর আবার ঠিক হয়ে যায়। আমার কোনো বন্ধুবান্ধব নেই। স্কুলজীবনে ছিল। এখন কারও সঙ্গে যোগাযোগ নেই। কিছু দিন আগে আমি খুব একা অনুভব করছিলাম। মনে হচ্ছিল ভাইবোন খুব প্রয়োজন। আমার আম্মু বলে, আমার কোনো সমস্যা নেই। আমাকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতে চায় না। আমি তাহলে কী করব?
উল্লেখ্য, সবাই বলে, মনের দিক থেকে আমি এখনো ১০-১১ বছর বয়সেই পড়ে আছি।
অরোরা, ঢাকা।
পরামর্শ: আবেগীয়ভাবে তোমার বয়স যে এখনো ২০ বছর হয়নি সেটা তুমি নিজেই বুঝতে পারছ। এটা প্রমাণ করে যে, অন্তত বুদ্ধি বিকাশের জায়গাটিতে তুমি বয়সের তুলনায় এগিয়ে রয়েছ। তুমি যেসব কাজে বুদ্ধি প্রয়োজন সেগুলো ঠিকমতো করতে পারছ। তাই তোমার আম্মু ভাবছেন, তোমার কোনো সমস্যা নেই। আমাদের দেশের অনেক অভিভাবকই যখন দেখেন তাঁদের সন্তানেরা লেখাপড়ায় ভালো করছে, তখন তাঁরা অন্যান্য বিকাশের জায়গাগুলো কম থাকলেও সেগুলোকে গুরুত্ব দেন না। আমার কাছে এমন অনেকেই এসেছে, যারা বিশ্বের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাফল্যের সঙ্গে পড়ালেখা করে বেরিয়ে এসেছে, কিন্তু তাদের সামাজিক ও আবেগীয় দক্ষতার জায়গাটি শিশুদের মতো রয়ে গেছে। অনেকের সঙ্গে মিশলে এবং জীবনে না পাওয়ার অভিজ্ঞতা থাকলে আমাদের ধৈর্য ধরার ক্ষমতা তৈরি হয়। তুমি কোনো ভাইবোন ছাড়া একা একা বড় হয়েছ এবং তোমাকে চাওয়া মাত্রই সব দেওয়া হয়েছে বলে অপেক্ষা করতে হলে যে আবেগটি তৈরি হয়, সেটা কখনো মোকাবিলা করতে হয়নি। বর্তমানে তোমার যে ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়েছে, সেটির জন্য ছেলেবেলায় তোমার চারপাশে যে পরিবেশ ছিল সেটার অবদান রয়েছে। তুমি যখন বাইরের কারও ওপর রাগ করতে গিয়েও পারছ না, তখন নিজের ওপর সেটির শোধ নিতে চাইছ। কিন্তু নিজেকে আঘাত করলে আমরা নিজের ওপরে খুব বেশি অবিচার করে ফেলি এবং আমাদের কিন্তু তা করার অধিকার দেওয়া হয়নি। চেষ্টা করে দেখো কিছু বন্ধুবান্ধব তৈরি করা সম্ভব কি না। যেহেতু তোমার বয়স এখনো অনেক কম, তুমি বিভিন্ন সুস্থ চর্চা করে এমন সংস্থাগুলোর সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পার। সামাজিকভাবে ভালোভাবে বাঁচতে চাইলে কিন্তু আজকাল অনেক কিছুই করার রয়েছে। তুমি মোটেও পাগল হয়ে যাওনি। মাকে বুঝিয়ে বলো, তুমি মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সাহায্য নিলে ভবিষ্যতে অনেক বেশি আবেগীয় নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চলতে পারবে। এবং একজন মোটামুটি সুখী মানুষ হিসেবে বাঁচতে পারবে। তোমাকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নয়, সাইকোথেরাপিস্টের কাছে যেতে হবে। আমি যে জায়গাগুলোর নাম সব সময় উল্লেখ করি সেসব জায়গা থেকে তুমি সাইকোথেরাপির সাহায্য নিতে পারলে খুব ভালো হয়।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ২৬, ২০১০
Leave a Reply