নির্জলা আনন্দ খোঁজা বা সমাজের চলমান ঘটনাকে সকলের সামনে উপস্থাপন করা, সব ক্ষেত্রেই একটু ভিন্নমাত্রা যোগ করা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ছাত্রদের নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় ভূত-উৎসবের সৃষ্টি।
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১০। সময়- সন্ধ্যা- ৭.৩০। স্থান- স্যার এ.এফ রহমান হলের শাহানেওয়াজ ভবনের মাঠ। দৃশ্যপর্বে হঠাৎই স্বস্ত্রীক ভূতরাজের আগমন। সাথে তার দেহরক্ষী, যে জাতীয় বক্ষব্যাধী হাসপাতাল থেকে সনদ প্রাপ্ত ও স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য প্রতিদিন ২০ বার ‘পিঠডন’ দেয়। ভূতরাজের আগমনের কিছু পরে তার সাথে উপস্থিত হয় অন্যান্য সঙ্গী ভূতরা। এর পরেই ঘটতে থাকে অদ্ভুত সব ভুতুড়ে ঘটনাঃ।
হরর কোনো উপন্যাসের নয়, চারুকলা অনুষদের ছাত্রদের নিজস্ব উদ্ভাবন ‘ভূত-উৎসবের’ শুরুটা হয়েছিল এভাবেই।
২০০০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া ভূত- উৎসব এর বিষয়বস্তুর নতুনত্বের কারণে ও হাস্যরসাত্মক উপস্থাপনের মাধ্যমে, এটি সম্পর্কে জ্ঞাত সকল মানুষের আগ্রহের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কিন্তু ভূত উৎসবকে চারুকলার ছাত্ররা একান্ত নিজস্ব একটি অনুষ্ঠান হিসেবে না রেখে, গণমানুষের উৎসবে পরিণত করতে ইচ্ছুক। ঢাকা চারুকলার ৫০তম ব্যাচ বা চারুকলা ইনস্টিটিউটের অনার্সের ৬ষ্ঠ ব্যাচের কিছু ছাত্রের মাথায় সর্বপ্রথম ভূত উৎসবের চিন্তা আসে। পরে অনার্সের ৭ম ব্যাচের সহযোগিতায় ৬ষ্ঠ ব্যাচের তত্ত্বাবধানে ভূত-উৎসব তার যাত্রা শুরু করে। শুরুতে এটি হাস্যরসাত্মক ও সাদামাটা একটা অনুষ্ঠান থাকলেও সময়ের কালক্ষেপণে এই উৎসবে যোগ হয়েছে নতুন অনেক মাত্রা। এবারের ভূত উৎসবের মূল আকর্ষণ ছিল ভূত রাজা। সর্বপ্রথমে মঞ্চে তার আগমন ঘটার পর তিনি নানা মর্তের কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে যান। যেমন টিভিতে সাক্ষাৎকার দেওয়া, রেডিওতে জঔ হিসেবে কাজ করা ইত্যাদি। পরবর্তীতে তার পদাঙ্গ অনুসরণ করে একে একে এসে উপস্থিত হয় নানা ধরনের, নানা পদের ভূতরা। যারা নাকি ভিন্ন ভিন্ন দেশ ও ভিন্ন ভিন্ন জাতি থেকে আগত, নিজেকে ভিন্ন একটি দেশ ও ভিন্ন একটি জাতি বোঝাতে সবাই সেই সেই জাতির কোনো ঐতিহ্যকে ধারণ করেছিল নিজেদের শরীরে। ভূত রাজার ‘ফিজিকাল গার্ড’ ‘সাইকেল ওকশন’ ‘ডেডিড বেকেবেকেহামহাম’ এমন সব অদ্ভুত ও মজাদার নামে নিজেদের নামকরণের সাথে সাথে অদ্ভুত সব সাজেও সেজেছিল ভূতরা। নিজস্ব একটি স্টাইল ও বৈশিষ্ট্য তৈরি করে নিয়ে সকলের সামনে নিজেদেরকে উপস্থাপন করার মাধ্যমে অনুষ্ঠানকে সচল রাখে তারা। সবশেষে সকল ভূতের একটি ভৌতিক নৃত্য ও ভৌতিক ডিজে পার্টির মাধ্যমে শেষ হয় অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান শেষে সব ভূতরা মিলে রাস্তায় শোভাযাত্রা বের করে এবং রাস্তায় অপ্রস্তুত মানুষকে অতর্কিত ভয় দেখাতে থাকে। শোভাযাত্রাটি শাহ্নেওয়াজ হল থেকে শুরু করে কুয়েত মৈত্রি হল পর্যন্ত এবং কুয়েত মৈত্রি হল থেকে আবার শাহানেওয়াজে ফিরে শেষ হয়। পুরো অনুষ্ঠান জুড়ে অনেক মজা করা হলেও নিছক মজা করার জন্য শুধু এই অনুষ্ঠান না। মজা করার সাথে সাথে বর্তমান সময়ের যে কোনো অনাচারকে ধিক্কার জানানো ও সেই বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়াও এই অনুষ্ঠানের আরো একটি উদ্দেশ্য। ইয়াসিন, মামুন, হোসাইন, সুমন, সবুজ, জুয়েল, আরেফিন, রাসেল, বাবু, মাহবুব তারেক, শোভনসহ প্রায় ২০ জন নিজেদের ভৌতিক সজ্জায় সবার সামনে উপস্থাপন করে ও বিভিন্ন মজার মজার কর্মকাণ্ড করে দেখান।
ভূত উৎসবের মঞ্চসজ্জা থেকে শুরু করে, সকল ভূতদের সাজসজ্জার আয়োজন সবকিছুই করে থাকে চারুকলার ছাত্ররা নিজেই। নিজেদের সাজানোর ক্ষেত্রে তারা মূলত ব্যবহার করে একরামিন ও জিংক অক্সাইড রঙ এবং এর সাথে ককসিটের বিভিন্ন কাঠামো তৈরি করে তার সাথে কাপড়ের ব্যবহার করে নিজেদেরকে ভূতরূপে প্রস্তুত করে। অন্যান্য বারের তুলনায় এবারের মঞ্চসজ্জা ছিল অনেক উন্নত ও দৃষ্টিনন্দন। নানা বর্ণের উজ্জ্বল আলোর সাথে সাথে সাইড স্ক্রিণে প্রজেক্টরের মাধ্যমে পুরো অনুষ্ঠানের সরাসরি সম্প্রচার এর মুগ্ধতাকে অনেকটা বাড়িয়ে দেয়। ভূত-উৎসব উপলক্ষে পুরো শাহ্নেওয়াজ হলকে ভৌতিক সজ্জায় সজ্জিত করা হয়। অন্ধকারে উন্মুক্ত মাঠের যাকের মঞ্চে নানা রঙ্গীন আলোর মাঝে বিভিন্ন ধরনের ভূতের আগমন তাই দর্শক মনে নানা ধরনের সেকের সৃষ্টি করে। সেই সাথে পুরো পরিবেশটাকে আরো বেশি ভৌতিক করে তোলার মাধ্যমে দর্শকদের ভূত দর্শনের আনন্দকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়।
ভিন্ন ধরনের এই আয়োজনের মাধ্যমে মানুষকে আনন্দ দেওয়ার এই প্রয়াস যেন আরো বড় ক্ষেত্রে নিজেকে মেলে ধরতে পারে এবং ভূত-উৎসব যেন পুরো দেশের মানুষের কাছে আরো বেশি সমাদৃত হয় এমনটাই আমাদের কাম্য।
সাজিদুল হক শুভ
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ফেব্রুয়ারী ২৪, ২০১০
Leave a Reply