অপুষ্টি বলতে কেবল হাড়জিরজিরে, কঙ্কালসার চেহারাই বোঝায় না-স্থূল, হোঁদলকুতকুত চেহারাকেও বোঝায়। সে অর্থে সারা বিশ্বেই রয়েছে অপুষ্টি। গরিব দেশে মানুষের যেমন পুষ্টির ঘাটতি হচ্ছে, তেমনি ধনী দেশে তেল, চর্বি, চিনি, মিষ্টি খাবার খেয়ে স্থূললোকের সংখ্যা বাড়ছে। সমস্যা হচ্ছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও বাচ্চারা ফাস্টফুড খেয়ে খেয়ে স্থূল হচ্ছে।
আমেরিকানদের স্বাস্থ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হলো মোটা ও স্থূল শিশুদের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলা। ইনস্টিটিউট অব মেডিসিন থেকে জানা গেল, আমেরিকান শিশুদের এক-তৃতীয়াংশই স্থূলতার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল দেখেছে, ১৯৮০ সালের পর ছয় থেকে ১১ বছর বয়সী স্থূল শিশুদের অনুপাত দ্বিগুণ হয়েছে এবং ভারী শরীরের তরুণের সংখ্যা বেড়েছে তিন গুণ।
আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়াট্রিকসের মতে, শিশুদের স্থূলতা বেড়ে যাওয়া শিশুস্বাস্থ্যের ওপর বেশ বড় রকমের চাপ সৃষ্টি করেছে। রবার্ট উড জনসন ফাউন্ডেশন, যে সংস্থা ২০১৫ সালের মধ্যে শিশুদের স্থূলতার মহামারি খণ্ডাতে প্রচণ্ড প্রচেষ্টা চালানোর ঘোষণা দিয়েছে ইদানীং, সেই ফাউন্ডেশনের সহসভাপতি ডা· জেমস এস মার্কস বলেন, ‘এখনই এসব শিশুর সমস্যা নিয়ে যদি কাজ না করি, তাহলে এই প্রজন্ম ক্রমে রুগ্ণ হয়ে পড়বে এবং হয়তো তাদের মা-বাবাদের আগেই মৃত্যুবরণ করবে।’
এ সমস্যা কিন্তু বিশ্বব্যাপী, তরুণদের মধ্যে স্থূলতা বাড়ছে সারা বিশ্বেই। এর পাশাপাশি স্থূলতার সঙ্গে সম্পর্কিত সব রোগের প্রকোপ বাড়ছে। যে সমাজ ক্ষীণদেহের মূল্য দিয়ে থাকে, একহারা শরীরের পূজারি যে সমাজ, সে সমাজে স্থূলতা বা ভারী শরীর হওয়ার সমস্যা তরুণদের আত্মমর্যাদা ও মানসিক স্বাস্থ্য দুটোর জন্যই যে কেবল ক্ষতিকর তা-ই নয়, দৈহিক স্বাস্থ্যেরও গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করে। ইন্টারনাল মেডিসিন বা শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের ক্লিনিক্যাল প্রফেসর ডা· মেলিসা এ কেইট বলেন, স্থূল শিশুদের অকাল স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখোমুখি এনে দাঁড় করায়, যেমন টাইপ-২ ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, উঁচুমান কোলেস্টেরল, এমনকি দুর্বল আচরণ-স্কুলে যেমন অমনোযোগ, বিশৃঙ্খল ব্যবহার, স্কুল পালানো এবং পরীক্ষায় কম নম্বর পাওয়ার মতো সমস্যা।
স্থূলতার পেছনে যেসব পরিবেশগত উপাদান রয়েছে, এগুলোর মধ্যে কয়েকটি হলো, অতিরিক্ত ফাস্টফুড খাওয়া, সরল শর্করা, সোডা, উঁচু চর্বিযুক্ত খাদ্য খাওয়া, বেশি পরিমাণ আহার, শরীরচর্চার অভাব, শুয়ে-বসে থাকা, গোটা শস্য-সবজি-শাক ও ফল কম খাওয়া। তবে এর প্রভাব বেশি পড়ে বাচ্চাদের ওপর এবং গণমাধ্যম একে আরও উচ্চকিত করে তোলে।
টাস্কফোর্স অন মিডিয়া অ্যান্ড চাইল্ডহুড ওবেসিটি অব দ্য ফেডারেল কমিউনিকেশনস কমিশনের মতে, আজকাল শিশুরা প্রতিদিন টেলিভিশন দেখে অনেক সময় অতিবাহিত করে এবং টিভি প্রোগ্রাম ও বিজ্ঞাপনচিত্র যেগুলো তারা দেখে, এগুলোর প্রচণ্ড প্রভাব পড়ে শিশুদের ওপর। দ্য কায়সার ফ্যামিলি ফাউন্ডেশনের মতে, তরুণ শিশুরা প্রোগ্রামের বিষয়বস্তু ও বিজ্ঞাপনচিত্র-এ দুটোর মধ্যে পার্থক্য ধরতে পারে না।
আমেরিকায় এ চিত্র ভয়াবহ।
আমেরিকান কংগ্রেস, চিলড্রেনস টেলিভিশন অ্যাক্ট অব ১৯৯০ রিপোর্টের মতে, শিশুদের বয়স ১৮ হওয়ার আগেই ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার ঘণ্টা সময় টিভি দেখে ফেলে এবং তারা দুই লাখ বিজ্ঞাপনচিত্রের মুখোমুখি হয়।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুরা যত ঘণ্টা বেশি টিভি দেখে, তাদের স্থূলতা তত বাড়ে। আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশু দিনে তিন ঘণ্টার বেশি টিভি দেখে, তাদের স্থূল হওয়ার আশঙ্কা শতকরা ৫০ ভাগ বেশি, যারা দুই ঘণ্টার বেশি সময় টিভি দেখে তাদের তুলনায়।
আরেকজন গবেষক বলেছেন, যেসব শিশু গণমাধ্যমের মুখোমুখি বেশি হয়, তাদের কাজকর্ম ও শরীরচর্চা কম। তাদের স্থূলতাও বেশি। ‘শিশুদের স্থূলতার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা’ শিরোনামের রিপোর্ট অনুযায়ী, শিশুদের স্থূলতা যে সময় থেকে নাটকীয়ভাবে বেড়ে চলেছে, সে সময় থেকেই শিশুদের লক্ষ করে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন অভিযানও বেড়ে চলেছে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, গড়ে একটি শিশু প্রতি পাঁচ মিনিটে খাদ্যের বিজ্ঞাপন দেখে থাকে। শিশুদের খাবার-পছন্দও এসব বিজ্ঞাপন দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত হয়ে থাকে। অন্যান্য গবেষক দেখেছেন, প্রতিদিন অতিরিক্ত এক ঘণ্টা টিভি দেখার সঙ্গে সঙ্গে তরুণদের মধ্যে ফল ও সবজি খাওয়া টিভি বিজ্ঞাপনের কারণে ক্রমে কমে গেছে।
এখন শিশুদের খাদ্যাভ্যাস ভালো করার জন্য মা-বাবারা কী করতে পারেন, শরীর মোটা হওয়ার পেছনে বা স্থূল হওয়ার পেছনে যেসব উপাদান, সেগুলো সম্পর্কে অবহিত করা, যেমন-খুব বেশি চর্বিযুক্ত খাবার, খাবার বড় লোকমায় খাওয়া, শরীরচর্চা না করা, নড়াচড়া বেশি না করা, গোটা খাবার বেশি না খাওয়া (ফল, শাকসবজি, গম ও আটার রুটি, গোটা শস্য)।
এ ছাড়া বাসার খাবারে বৈচিত্র্য না আনা, একঘেয়ে খাবার, যেমন-খাসি বা গরুর মাংস বা ডিম, আলু বা ভাত-এ রকম খাবার ক্রমাগত খাওয়া। বাসায় সোডা, কোমল পানীয়, মিষ্টি না খাওয়া। হয়তো কালেভদ্রে মিষ্টি-পায়েস খাওয়া যেতে পারে।
তৃতীয়ত, গোটা শস্যখাদ্য প্রস্তুত করার সহজ প্রণালী শেখানো (যেমন-আগে থেকে ধোয়া, কাটা ফল ও কাটা সবজি, ওট্মিল, আটার রুটি, আগে থেকে রান্না করা স্বাস্থ্যকর স্ম্যাকস বা কচি মোরগের বুকের ঝোল বা পনির বা সেদ্ধ ডিম-এগুলো হবে স্বাদু ও খেতে সহজ।
চতুর্থত, এদের ব্যায়াম করতে উৎসাহিত করা। গাড়িতে করে স্কুলে পৌঁছে দেওয়া কেন? সাইকেলে চড়ে যাক না। খেলাধুলায় অংশ নিতে উৎসাহিত করুন। মাঠে খেলতে দিন, হাঁটতে দিন।
পঞ্চমত, প্রতিদিন টিভি দেখা কমাতে বলতে হবে। আর টিভি কমার্শিয়াল হলে শব্দ বন্ধ করার কৌশল শেখাতে হবে। অর্থাৎ তাদের শেখাতে হবে সবল ও স্বাস্থ্যবান থাকার জন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া ও নিয়মিত ব্যায়াম করা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ২৭, ২০০৯
Leave a Reply