বাবা-মা আর সন্তানের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সমঝোতা। সমঝোতার হাত প্রথম বাড়াতে হবে বাবা-মাকেই, তাই বলে সন্তানদের যে কিছু করার নেই তা কিন্তু নয়। পারস্পরিক এই সমঝোতা নিয়ে আমাদের এবারের আয়োজন লিখেছেন নওশীন শর্মিলী
সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বদলে যাচ্ছে সম্পর্কের সমঝোতা। বাবা-মা অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত শরীরে বিশ্রাম নেন। কিংবা সংসারের কাজে নিজেদের ব্যস্ত করে রাখেন। তখন সন্তানের ছোট্ট একটা ভুল, একটা আবদার কিংবা ধরা যাক একটা নতুন ইচ্ছাই বাড়াবাড়ি মনে হয়। ধমকে দেন তাকে। আর সন্তানরা ভাবেন আমি এতই তুচ্ছ যে আমাকে কোন গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না! এ ভাবনা থেকে মন খারাপ করে বসে থাকা। অনেক সময় নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে চলে মনের সাথে যুদ্ধ। মানসিক চাপ বাড়তে থাকে। মন বসে না পড়ার। এতে বাবা-মা’র ক্ষতির চেয়ে ক্ষতি বেশি হয় সন্তানের। তাই বিষয়গুলো সহজভাবে নেয়ার চেষ্টা করুন। বুঝতে চেষ্টা করুন বাবা-মা প্রয়োজনেই সারাদিন কাজে থাকছে। এ কারণে একটু ক্লান্তিও আছে তাদের। আপনাদের জন্যই তাদের এই পরিশ্রম। তাই অফিস থেকে ফেরার পরপর কোন বিষয়ে আলাপ না করে বিশ্রাম নেয়ার পর আস্তে ধীরে আপনার সমস্যার কিংবা চাওয়ার কথা তুলে ধরুন। নিজেদের মেজাজ মর্জি আর বাবা-মা-এর একরোখা ভাবের জন্য যে সমস্যার সৃষ্টি হয়, তাতে আপনার ভূমিকা কতটুকু তা নতুন করে একটু ভেবেই দেখুন না।
সন্তানরা কথা
শোনে না
নিরাপত্তার অভাব, অভিমান, অভিযোগ থেকে জন্ম নেয় দূরন্তপনা, অবাধ্যতা। নিজের সন্তানকে একজন পরিণত মানুষ হিসেবে দেখুন। তাদের মতামতের গুরুত্ব দিন। ‘ও ছেলে মানুষ কিছু বোঝে না’ ওদের সামনে এ ধরনের কথা বলবেন না। নিজের আচরণ ঠিক রাখুন। যেন তার সামনে আপনি মডেল হতে পারেন। সন্তানদের সামনে ঝগড়া করবেন না, সন্তানদের অসুবিধা বা সমস্যার কথা বলতে দিন। শুনতে তুচ্ছ মনে হলেও সেখান থেকে পেতে পারেন সমস্যার মূল। অতিরিক্ত শাসনে, না পাওয়ার হতাশায় সন্তানকে ব্যথিত করবেন না। অফিসের টেনশন বাড়িতে আনবেন না। যথেষ্ট সময় দিন। কোন সমস্যায় পড়লে তাকে সমাধানের উপায় বলে দিন। দেখবেন সেও আপনার চাওয়া পূরণ করতে চাইছে।
আপনি কতোটা মানেন
বর্তমানে বিশ্বটা খুব অস্থির গতিতে এগুচ্ছে। আপনি ভাবছেন বাবা-মা তা বুঝতে চাইবে না। তাই আপনার ফাস্টফুড খাওয়া, প্রতি সপ্তাহে বন্ধুর জন্মদিনে উপহার দেয়া, নতুন ছবির সিডি কিংবা কম্পিউটারের নতুন সিস্টেম দিতে তারা দেরি করছেন। তাতে রাগে তাদের শত্রু ভাবতেও আপনার আপত্তি নেই। প্রতিদিনই চাওয়াগুলো মনে করিয়ে একটা তিক্ততা সৃষ্টি করছেন। কিন্তু একটু খতিয়ে দেখবেন কি তারা কি ইচ্ছা করেই আপনার চাওয়া পূরণ করছে না নাকি। প্রতিদিন বাড়ছে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম। তার সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ছে না তাদের আয়। এই কথাটা আপনি না বুঝলে কে বুঝবে। তাই ভালভাবে জেনে নিন। আপনার চাওয়া পূরণ করতে তারা কতোটা সমর্থ।
নিজের সামাজিক অবস্থান
বাবা-মা জীবন যুদ্ধে ব্যস্ত আর আপনি থাকেন বাড়িতে। এই সুযোগে বাড়িতে প্রায়ই বন্ধু-বান্ধবীদের নিয়ে আড্ডা বসান। একটু ভাবেন না পাশের প্রতিবেশিদের এই হুল্লোরে কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা। তারা অভিযোগ করে আপনার অভিভাবকের কাছে। ব্যাপারটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে অনুমান করতে পারছেন। আপনার আনন্দের জন্য অপমানিত হচ্ছেন বাবা-মা। অন্যের ব্যঙ্গ বাক্যে অতিষ্ট হয়ে এর ঝাল মেটাচ্ছেন আপনার ওপরও। তাতে আপনারও কম অপমান হল না। তাই আনন্দ করার সময় নিজের অবস্থান সম্পর্কে ভাবুন। এই আনন্দের জের কতদূর যেতে পারে তা মাথায় রাখুন।
নতুন জগত
তরুণ-তরুণীদের আস্তে আস্তে নতুন জগতের সাথে পরিচয় হয়। সেখানে বন্ধু-বান্ধব, প্রেম ভালোবাসা ডানা মেলতে শুরু করে। বন্ধুর জন্মদিনে যাওয়া, পিকনিক কিংবা কোন স্টাডি ট্যুারে যাওয়ার অনুমতি দিন। অসুবিধা থাকলে বুঝিয়ে বলুন। বিশেষ বিশেষ দিনে উপহার দিন কিংবা বাইরে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যান। খোলাখুলি আলোচনা ও স্বীকারোক্তির পথ খোলা রাখুন। মিথ্যে বললে, বুঝতে চেষ্টা করুন কেন মিথ্যে বলছে। মিথ্যে বলা অন্যায় এই বিশ্বাস ছেলেবেলা থেকে সন্তানদের মধ্যে তৈরি করুন, তা নাহলে ভবিষ্যতে বড় সমস্যা হতে পারে। নিজেও মিথ্যে বলা থেকে বিরত থাকুন। মিথ্যে ধরা পড়লে অপরাধবোধ সৃষ্টি হয় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করুন।
সংসারের প্রয়োজন, নিজেদের সামর্থ, সামাজিক অবস্থান সন্তানদের সামনে তুলে ধরুন। তাদের স্বপ্ন অনুভূতি, বিশ্বাস, চিন্তা-ভাবনাকে গুরুত্ব দিন। সন্তানকে নিজের মতো করে বড় হতে দিন। তাদের কখনো নিজের ইচ্ছা পূরণের মাধ্যম বানাবেন না। পক্ষান্তরে সন্তানদেরও উচিত এই বয়স থেকে নিজেকে একজন আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মানুষ করে গড়ে তোলা। বাবা-মা তাদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যে শ্রম দিয়েছেন তার মূল্য এখন থেকেই দিতে জানতে হবে।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ফেব্রুয়ারী ২৪, ২০১০
Leave a Reply