ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে ক্লান্তি ও অলসতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এটা যে শুধু রক্তে অনিয়ন্ত্রিত গ্লুকোজের জন্য ঘটে থাকে তা নয়, অন্যান্য কারণেও ক্লান্তি লাগতে পারে। এর মধ্যে একটি কারণ রক্তস্বল্পতা। এটি সম্পর্কে সচেতনতা ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে খুব কমই দেখা যায়। সঠিকভাবে রক্তস্বল্পতা শনাক্ত করা গেলে ও চিকিৎসা করলে এটি নিয়ন্ত্রণে থাকে। রক্তস্বল্পতা ডায়াবেটিস রোগীদের কিডনি জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার একটা কারণ।
ডায়াবেটিস, কিডনি ও রক্তস্বল্পতা
কিডনি রোগের ক্ষেত্রে, কিডনি সমস্যা বোঝার অনেক আগেই রক্তস্বল্পতা ঘটে থাকে। সম্প্রতি কিডনি ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞরা প্রাথমিক পর্যায়ে এনিমিয়া হওয়ার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছেন। ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে কিডনির সমস্যা বেড়ে যাচ্ছে। ডায়াবেটিসের কারণে সাধারণত কিছু ছোট রক্তনালি (যা কিডনির সঙ্গে সংযুক্ত) পরিবর্তন হয়ে যায়। যদিও বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে এ চিন্তাটা থাকে যে কিডনি নষ্ট হওয়া প্রতিরোধ করতে হলে এই রক্তনালিগুলো পরিবর্তন হওয়া প্রতিরোধ করতে হবে। কিডনি অসমর্থতা হলো রেনাল এনিমিয়া। এই রেনাল এনিমিয়া শুরু হয় কিডনির কার্যকারিতা নষ্ট হতে শুরু হওয়ার প্রথম পদক্ষেপ থেকেই, এমনকি যারা ডায়ালাইসিস শুরু করেনি, তাদের মধ্যেও রেনাল এনিমিয়া দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় জাতীয় স্বাস্থ্য ও পুষ্টি পরীক্ষা সমীক্ষায় দেখা গেছে যে কিডনির কার্যকারিতা কমে যাওয়ার সঙ্গে হিমোগ্লোবিন কম থাকা এবং রক্তস্বল্পতা হওয়ার জোরালো সম্পর্ক রয়েছে।
ইরাইথ্রোপ্রোটিনের কার্যকারিতা হ্রাস
ইরাইথ্রোপ্রোটিন হলো কিডনি থেকে সৃষ্ট এক ধরনের আমিষ, যা লাল রক্তকণিকা উৎপাদন করে। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে যেমন ডায়াবেটিক নেফ্রোলজি, কিডনি ফেইলিওর, টিউমারে প্রদাহ অথবা টিউমারের জন্ম ইরাইথ্রোপ্রোটিন উৎপাদন ব্যাহত অথবা একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। ফলে লাল রক্তকণিকার সংখ্যা কমে যায় এবং এর ফলে হিমোগ্লোবিন কমে রক্তস্বল্পতার সৃষ্টি হয়। যখন শরীরে লাল রক্তকণিকা কমে যায় এবং লাল রক্তকণিকায় অবস্থিত হিমোগ্লোবিন অস্বাভাবিক কমে যায়, তখন রক্তস্বল্পতা দেখা দেয় এবং এ কারণে রক্তে অক্সিজেন পরিবহন করার ক্ষমতা কমে যায়।
নিয়মিত পরীক্ষা করাতে হবে
ডায়াবেটিস চিকিৎসার ক্ষেত্রে রক্তস্বল্পতাকে বেশির ভাগ সময়ই চিকিৎসার আওতায় আনা হয় না বা গুরুত্বই দেওয়া হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের একজন ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ডায়াবেটিসের রোগীরা যখন ক্লান্তিতে ভুগছে মনে করে, তাদের ধারণা, এটা হচ্ছে রক্তে চিনির পরিমাণ কমে যাওয়ার জন্যই। কিন্তু রোগীরা ক্লান্ত বা অবসন্নতায় ভুগছে বলে জানালে তখনই এনিমিয়া পরীক্ষা দরকার। দেখা গেছে ক্লান্ত ডায়াবেটিসের রোগীদের বেশির ভাগই এনিমিয়ায় ভুগছে। একটি জরিপে দেখা গেছে যে ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে মাত্র ১ শতাংশ রোগী রক্তস্বল্পতা পরীক্ষা করান।
চিকিৎসা না করালে যা হয়
যদি সঠিক সময়ে রক্তস্বল্পতার সঠিক চিকিৎসা করা না হয়, তবে হৃদযন্ত্রের ভয়াবহ ক্ষতি হতে পারে। কারণ, অক্সিজেন বহন করে যে হিমোগ্লোবিন, তা প্রচুর পরিমাণে কমে যাওয়ার কারণে হৃদযন্ত্র ঠিকমতো চলতে পারে না। এনিমিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ২০ শতাংশ রোগীরই হৃদযন্ত্রের সমস্যা থাকে। যেসব ডায়াবেটিস রোগী কিডনি জটিলতায় ভুগছে এবং কখনো ডায়ালাইসিস করেনি, তাদের মধ্যে এমনটা দেখা যায়। হৃদরোগ জটিলতার সঙ্গে যদি এনিমিয়া যুক্ত হয়, তবে তা রোগীর জীবনের ওপর ভয়াবহ বিরূপ প্রভাব ফেলে। এনিমিয়ায় আক্রান্ত হলে ডায়াবেটিসের রোগীদের কাজের দক্ষতা, পারিবারিক সম্পর্ক, সামাজিক সম্পর্ক সবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলেন, রক্তস্বল্পতার চিকিৎসা হলো রক্ত সংযোজন করা। এই চিকিৎসাই বেশির ভাগ সময় দেওয়া হয়। যদিও এটি অনেক ব্যয়বহুল এবং এতে ঝুঁকিও রয়েছে। যাদের অনেক দিন ধরে কিডনির সমস্যা রয়েছে, ইরাইথ্রোপ্রোটিন তাদের জন্য নিরাপদ ও কার্যকর চিকিৎসা হতে পারে। ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগীদের মধ্যে এনিমিয়া থেকে মুক্তি দিতে ইরাইথ্রোপ্রোটিন একটি ভূমিকা রাখতে পারে। সম্প্রতি একটি গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে যদি ইরাইথ্রোপ্রোটিনের পরিমাণ ঠিক করা যায়, তাহলে রক্তস্বল্পতা সম্পূর্ণ সেরে যেতে পারে।
সচেতনতা প্রয়োজন
ডায়াবেটিস রোগীদের এনিমিয়া নির্ণয় করা ও এর যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া প্রয়োজন। রক্তস্বল্পতা থেকে দুর্ভোগ এড়ানো এবং এ থেকে হৃদরোগে ক্ষতি কমানোর জন্য এনিমিয়া সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। ডায়াবেটিক ও কিডনি চিকিৎসকদের মধ্যে সমন্বয় থাকা জরুরি, যেন রোগীরা এ দুই ধরনের বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে সমন্বিত চিকিৎসা পেতে পারে। এ জন্য বিভিন্ন কর্মশালা ও সুষ্ঠু যোগাযোগ পরিকল্পনার মাধ্যমে এ দুই ধরনের বিশেষজ্ঞের মধ্যে রক্তস্বল্পতা সম্পর্কে জ্ঞান বৃদ্ধি করতে হবে। একই সঙ্গে ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যেও রক্তস্বল্পতা সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিতে হবে। ডায়াবেটিস রোগীদের অসুখ ও জটিলতা সম্পর্কে বোঝাতে হবে এবং এই তথ্য আরও জানার ও মেনে চলার জন্য তাদের উৎসাহিত করতে হবে।
সোমা সাহা
গবেষক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি
সূত্রঃ ডায়াবেটোলজিয়া জার্নাল
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ২৭, ২০০৯
Leave a Reply