সুন্দর হতে চায় না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মনে হয় খুবই মুশকিল। তার চাইতেও বেশি মুশকিল সৌন্দর্য চর্চা করে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া। একজন মানুষ তখনই সুন্দর হতে পারে যখন তার সৌন্দর্য প্রকাশের মাধ্যমগুলো অর্থাৎ ত্বক, চুল, নখ ইত্যাদি সুন্দর হবে। আর এগুলো সুন্দর করার জন্য প্রয়োজন নিয়মিত চর্চা। আর এই চর্চায় আপনি হয়তো জেনেশুনেই ব্যবহার করছেন নানা ক্যামিকেল যুক্ত পণ্য। এসব পণ্য নানা পাশ্ব প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এ সকল পণ্য বা প্রসাধনী সাময়িকভাবে আপনাকে সুন্দর করে তুললেও ধীরে ধীরে আপনার সৌন্দর্য যে চিরতরে নষ্ট করে দিচ্ছে তা আপনি টেরই পাচ্ছেন না। তাই রূপচর্চায় প্রয়োজন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত উপাদান। আর এ জন্য রূপচর্চায় প্রয়োজন ভেষজ উপাদান। ভেষজ উপাদানের মধ্যে রয়েছে নিম, হলুদ, লেবু, গোলাপ, জবা, আমলকি, হরিতকি ইত্যাদি। তাই আসুন জেনে নিই কিভাবে আমরা ভেষজ উপায়ে ত্বক ও চুলের যত্ন করতে পারি। লিখেছেন মোর্শেদ নাসের
ত্বকের যত্ন
চাকরি, পড়াশোনা ইত্যাদি বিভিন্ন কাজে দিনের বেশির ভাগ সময় আমাদের বাইরে থাকতে হয়। তাই বাইরে থেকে এসে মুখ ধোয়া খুবই জরুরী। আর এক্ষেত্রে আমরা কেমিক্যালযুক্ত ক্লিনজিং মিল্ক ব্যবহার না করে ভেষজ উপায়ে মুখ পরিষ্কার করতে পারি। দুই চা চামচ দুধের সাথে এক চিমটে হলুদ গুঁড়া মিশিয়ে নিতে হবে। তারপর তাতে তুলা ভিজিয়ে মুখ পরিষ্কার করতে হবে।
০ ত্বক পরিষ্কার করার জন্য দুধ ও লেবুর রস একসঙ্গে মিশিয়ে তুলায় ভিজিয়ে মুখে লাগিয়ে নিন। শুকিয়ে গেলে ধুয়ে ফেলুন।
ঔজ্জ্বল্য বাড়াতে
০ ত্বকের রং উজ্জ্বল করতে হলুদ বাটা ও চন্দনের গুঁড়া মিশিয়ে লাগান।
০ কাঁচা হলুদ বাটা, ময়দা ও দুধের সর একসাথে মিশিয়ে ভালো করে মুখে মাখুন। ১৫ মিনিট পর মুখ ধুয়ে ফেলুন।
০ মধু, জলপাই তেল, চন্দন বাটা ও এক চিমটে হলুদের মিশ্রণ মুখে মাখালে ত্বক উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।
০ শসার রস মুখে লাগিয়ে পাঁচ-সাত মিনিট রাখার পর এক কাপ পানিতে অর্ধেক পরিমাণ লেবুর রস মিশিয়ে সে পানিতে তুলো ভিজিয়ে তা দিয়ে শসার রস তুলে ফেলতে হবে।
০ তৈলাক্ত ত্বকের ক্ষেত্রে দইয়ের সঙ্গে লেবুর রস মিলিয়ে সারা মুখে মেখে রাখুন। তারপর কয়েক মিনিট পর ভেজা তুলো দিয়ে মুছে ফেলুন।
০ গোলাপ, পুদিনা, আমলা, বাঁধাকপি ও শসার নির্যাস একসাথে মিশিয়ে টোনার তৈরি করে মুখে লাগালে তা ত্বককে মসৃণ করে তোলে।
০ ত্বকের হারানো ঔজ্জ্বল্য ফিরিয়ে আনার জন্য আমন্ড, বাদামি গোলাপের পাপড়ি এবং দুধের সর দিয়ে বেটে মুখে লাগান।
০ ত্বককে টানটান করার জন্য ত্বকে লেবুর খোসা ঘষুন। লেবুর খোসায় উপস্থিত অ্যাসিটনজেন্ট লোমকূপ বন্ধ করে ত্বককে টানটান করে।
০ ত্বকে যদি অন্যরকম এক আভা নিয়ে আসতে চান তাহলে মসুর ডাল বাটা, নিম পাতা বাটা, কাঁচা হলুদ বাটা, দই মধু একসঙ্গে মিশিয়ে পুরো মুখে লাগিয়ে রাখুন। শুকিয়ে গেলে ধুয়ে ফেলুন।
০ কাঁচা হলুদ, সরষের তেল, রসুন একসঙ্গে ফুটিয়ে বাচ্চার পুরো গায়ে ম্যাসেজ করলে গায়ের রং উজ্জ্বল হবে।
০ কাঁচা হলুদ ও সাদা সরষে বেটে তার সঙ্গে একটু বেসন মিশিয়ে শিশুর গায়ে লাগালে শিশুর লোম কম হয়।
০ ত্বক উজ্জ্বল করার জন্য এক কাপ ফুটানো দুধে আধ খানা লেবুর রস দিন। এতে আধা চা-চামচ গ্লিসারিন মিশিয়ে আধা ঘন্টা রেখে দিন। রাতে শোয়ার আগে এটি মুখে ও হাতে পায়ে মেখে নিন।
০ বয়স ধরে রাখতে বা মুখে বয়সের ছাপ কমাতে চাইলে প্রতিদিন ডাবের পানিতে লেবুর রস দিয়ে পান করুন।
০ যাদের মোটা শরীর তারা দেহের চর্বি কমাতে এক গ্লাস পানিতে একটি পুরো পাকা লেবুর রস এবং চার চা-চামচ মধু মিশিয়ে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে পান করুন।
ব্রণ সারাতে
০ সমপরিমাণ নিমপাতা ও চন্দন বেটে মুখে প্রলেপ দিন। আধঘন্টা পর ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহখানেক এইভাবে করলে ব্রণ পুরোপুরি চলে যাবে।
০ ৫০ গ্রাম নিমপাতা আধাকেজি পানিতে ফুটাতে থাকুন যতক্ষণ না পর্যন্ত পানির পরিমাণ অর্ধেক হয়ে যায়। প্রতিদিন সকালে খালি পেটে এই পানি পান করলে ত্বকে ব্রন বের হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকবে।
০ যাদের মুখে ব্রণ আছে তারা দিনে দুই-তিনবার লেবুর রস ব্রণের উপরে লাগান। তাতে ব্রণ অনেকটাই কমে যাবে।
দাগ সারাতে
০ অনেকের মুখেই কালো কালো দাগ দেখা যা সৌন্দর্য নষ্ট করে দেয়। ১ চা-চামচ ধনিয়ার রসের সাথে এক চিমটে হলুদ গুঁড়া মিশিয়ে সারারাত মুখে লাগিয়ে রেখে দিন। সকালে উঠে ঠান্ডা পানির ঝাপটায় পুরো মুখ ভালো করে ধুয়ে ফেলুন। দেখবেন কয়েক দিন ব্যবহারেই উপকার পাচ্ছেন।
০ যাদের মুখে মেচতা আছে তারা ১ চা চামচ সাদা জিরে গুঁড়া, ১চা-চামচ হলুদ গুঁড়া ১চা চামচ সরষে গুড়া ও ১ চা-চামচ আটা মিশিয়ে পেস্ট বানিয়ে মেচতার উপর লাগান। বিশ মিনিট রেখে ঠান্ডা পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলুন।
০ আপনার মুখে যদি ব্রণের দাগ থাকে তবে প্রতিদিন গোলাপ জল দিয়ে মুখ ধুয়ে নিন। দেখবেন ব্রণের দাগ ক্রমশ হালকা হয়ে যাচ্ছে।
০ মুখে ক্লান্তির ছাপ পড়ে গেলে সেই ছাপ কাটাতে চন্দন বাটা, তুলসি বাটা গোলাপ জলে মিশিয়ে গলায় ও মুখে লাগান। দেখবেন ত্বক চকচকে হয়ে গেছে।
স্ক্রাবার বা মাস্ক হিসেবে
০ মরা কোষ উঠানোর জন্য আমাদের স্ক্রাবার ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু আমরা ভেষজ উপাদান দিয়েই স্ক্রাব করতে পারি। এ জন্য ১ চা চামচ করে আতপ চাউলের গুঁড়া, মধু, মেথি, মসুর, ডাল বাটা, কাঁচা হলুদ বাটা, চন্দন বাটা ডাবের পানির সাথে মিশিয়ে পুরো মুখে লাগিয়ে রাখুন। বিশ-পঁচিশ মিনিট পর তা ধুয়ে ফেলুন।
০ ত্বককে মসৃণ করার জন্য ১ কেজি পরিমাণ মসুর ডাল গুঁড়া করে তাতে আধা টেবিল চামচ হলুদ গুড়া, শুকনো পোলাপ পাপড়ি গুঁড়া, চার টেলি চামচ বেসন মিশিয়ে নিন। এ মিশ্রণটি গোলাপ জলের সঙ্গে মিশিয়ে আপনি মাস্ক হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। এ মাস্কটি মুখে ও গলায় লাগিয়ে পনের মিনিট শুয়ে থাকুন। শুকিয়ে গেলে ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
০ সমপরিমাণ ভিনেগার ও লেবুর রস একসঙ্গে মিশিয়ে পানি দিয়ে পাতলা করে নিয়ে ত্বকে টোনার হিসেবে ব্যবহার করুন।
০ মুলতান মাটি, গোলাপ জল ও চন্দন গুঁড়া এক সঙ্গে মিশিয়ে মুখে লাগান। বিশ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন। এ উপকরণটি সব ধরনের ত্বকের জন্যই উপযোগী।
চুলের যত্নে
সৌন্দর্য প্রকাশের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হচ্ছে চুল। আপনার ত্বক যতই সুন্দর হোক না কেন আপনার চুল যদি হয় উসকো খুশকো তবে আপনাকে নিশ্চয় সুন্দর দেখাবে না। আর তাই চুল সুন্দর করতে প্রয়োজন নিয়মিত যত্ন। এখন আসুন জেনে নিই ভেষজ উপাদান দিয়ে কীভাবে চুলের যত্ন করব।
০ চুলকে মসৃণ করতে হলে কচি আমলকির রস ক্যাস্টর অয়েলের সঙ্গে মিশিয়ে মাথায় ৪০ মিনিট রেখে শ্যাম্পু করে নিন।
০ চুল কালো করতে চাইলে জবা ফুলের রস লাগান।
০ পুষ্ট ও ঝলমলে চুলের জন্য পাকা কুমড়ার বীজ চিবিয়ে খাওয়া যেতে পারে। পাকা কুমড়ার বীজ শুকিয়ে বায়ু নিরোধক পাত্রে রেখে দিন এবং মাঝে মধ্যে চিবিয়ে খান।
০ চুলের বৃদ্ধি ঘটাতে পেঁয়াজের রস পুরো মাথায় লাগান। শুকিয়ে গেলে শ্যাম্পু করে ফেলুন।
০ শ্যাম্পুর বিকল্প হিসেবে আপনি চুলে রিটা ব্যবহার করতে পারেন। এক মুঠো রিটা সারা রাত ভিজিয়ে রেখে সকালে সেই পানি ফুটিয়ে নিন। তারপর তা চুলে শ্যাম্পুর বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করুন।
০ মসুর ডাল বাটার সাথে লেবুর রস মিশিয়ে চুলে প্যাক হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। আধঘন্টা মাথায় রেখে ধুয়ে ফেলুন। এতে চুল সতেজ হবে।
০ সারারাত মেথি ও কয়েকটা কাঁচা আমলকী পানিতে ভিজিয়ে রাখুন। পরদিন তা বেটে চুলে লাগান।
০ চুল ঝরঝরে করার জন্য মেহেদী, আমলকি, টকদই ও ডিম ভালোভাবে মিশিয়ে চুলে মাখুন এবং একঘন্টা পর চুল শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ফেব্রুয়ারী ২৩, ২০১০
Leave a Reply