প্রকৃতিতে লেগেছে ফাগুনের হাওয়া। ঝরাপাতাদের দিনের হলো অবসান। নতুন কুঁড়িরা দিতে শুরু করেছে উঁকি। ওদিকে লাল, নীল, হলুদ ফুলেরা খেলায় মেতেছে প্রজাপতিদের সঙ্গে।…প্রকৃতি যখন নিজেকে সাজাতে এত ব্যস্ত, আপনি কি নিশ্চুপ থাকবেন? ফুল-পাখির সৌন্দর্যের সঙ্গে ধুলার ওড়াউড়িও কম নেই। রোদটাও যেন আরও তেজি হচ্ছে। আর তাই এ সময়টায় আপনার ত্বকের চাই একটু বাড়তি পরিচর্যা।
এ সময়ে আমাদের শরীরের ত্বক, চুলও শুষ্ক থাকে, আর্দ্রতা কমে যায়, পাশাপাশি মরা চামড়া উঠতে থাকে। সে কারণেই এ সময় আমাদের ত্বকের যত্নের দিকে মনোযোগী হওয়া দরকার। বলছিলেন হারমনি স্পার কর্ণধার রাহিমা সুলতানা। এ সময় ধুলাবালির প্রকোপটা বেশি, তাই ত্বকের পরিচ্ছন্নতার বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেন তিনি। যাঁরা বাইরে বের হন, তাঁরা যখনই সুযোগ পাবেন মুখ-হাত ধুয়ে নিন। ত্বকে যেন কোনোভাবে বেশিক্ষণ ধুলাবালি আটকে না থাকে। দিনে অন্তত তিনবার হাত-মুখ ধোবেন। ব্যাগে ছোট একটা ফেসওয়াশ রেখে দিন অথবা এক প্যাকেট ভেজা টিস্যু (ওয়েট টিস্যু) রেখে দিন। কাজের ফাঁকে মুখটা মুছে নিন। আপনার ত্বক পরিষ্কারের পাশাপাশি সতেজও দেখাবে। এ সময় রোদের তীব্রতা বেশি থাকে। তাই অবশ্যই সানস্ক্রিন লোশন বা সানব্লক ক্রিম লাগাতে ভুলবেন না। সানস্ক্রিন বেছে নিন আপনার ত্বকের ধরন অনুযায়ী। তৈলাক্ত ত্বক যাঁদের, তাঁরা পানিযুক্ত সানস্ক্রিন এবং শুষ্ক ত্বক যাঁদের, তাঁরা তেলযুক্ত সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন। যাঁরা কেমিক্যাল সহ্য করতে পারেন না, তাঁদের প্রাকৃতিক সানস্ক্রিন ব্যবহারের পরামর্শ দেন রাহিমা সুলতানা। সানস্ক্রিন হিসেবে তিলের তেল খুব ভালো। তবে তৈলাক্ত ত্বক যাঁদের, তাঁদের এটা না লাগানোই ভালো। তাঁরা শুধু পাউডার লাগাতে পারেন।
বাইরে থেকে ফিরে খুব ভালোভাবে হাত-মুখ ধোবেন। মুখ ধুয়ে অবশ্যই ময়েশ্চারাইজার দিন। ত্বক ভেজা থাকতে থাকতে ময়েশ্চারাইজার লাগালে বেশি ভালো। এ সময় অনেকেরই মৃত চামড়া বা মৃত কোষগুলো উঠতে দেখা যায়। মৃত কোষগুলো খুব ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে। তা না হলে লোমকূপ বন্ধ হয়ে যায়। সপ্তাহে অন্তত একবার ত্বকে স্ক্রাব লাগান। অনেকেই শুধু মুখমণ্ডলের যত্ন নেন; হাত, পা, গলা, ঘাড়ের দিকে ততটা নজর দেন না। সবটুকু মিলেই তো আমাদের সৌন্দর্য, তাই না? তাই অবশ্যই হাত, পা, ঘাড়সহ সারা শরীরের ত্বকেরই যত্ন নিন।
আপনি ঘরে বসেই তৈরি করে নিতে পারেন প্রাকৃতিক স্ক্রাব।
মুখে স্ক্রাব হিসেবে পাউডার ধরনের স্ক্রাব বেছে নিন। কারণ, মুখের ত্বক আমাদের শরীরের অন্যান্য ত্বকের চেয়ে কোমল। বেসন অথবা ময়দা বেছে নিতে পারেন মুখের জন্য স্ক্রাব হিসেবে।
হাত, পা, গলা, ঘাড়ে স্ক্রাব হিসেবে চালের গুঁড়ো ব্যবহার করতে পারেন। এটা দানাদার বলে মৃত কোষ পরিষ্কারে খুব ভালো কাজ করে।
চালের গুঁড়ার সঙ্গে গাজরের রস মিশিয়েও লাগাতে পারেন। এতে ত্বকের ঔজ্জ্বল্য বাড়ে। তা ছাড়া কাঁচা হলুদের রসও খুব ভালো কাজ করে।
সয়াবিন গুঁড়ার সঙ্গে তিলের তেল মিশিয়ে সারা শরীরে লাগাতে পারেন। অথবা ময়দার সঙ্গে জলপাই বা নারকেল মিশিয়ে লাগাতে পারেন।
স্ক্রাব লাগিয়ে ১০-১৫ মিনিট রাখুন। ধোয়ার সময় হালকা করে ম্যাসেজ করুন। এতে মৃত কোষ উঠে যাওয়ার পাশাপাশি ত্বকে রক্তসঞ্চালনও বাড়বে। এই ম্যাসেজটা ত্বকের জন্য খুব উপকারী। ধুলায় ধূসরিত পথে হেঁটে এ সময় আপনার পায়েরও নিশ্চয়ই বেহাল অবস্থা। তাই সুন্দর দুখানি পায়ের জন্য একটু কষ্ট করুন। বাইরে থেকে ফিরে কুসুম গরম পানিতে শ্যাম্পু মিশিয়ে ১০ মিনিট পা ভিজিয়ে রেখে ধুয়ে মুছে নিন। তারপর পেট্রোলিয়াম জেলি লাগান। ত্বকে এ সময় অনেকেরই রোদে পোড়া কালো ছোপ ছোপ দাগ পড়ে। এ জন্য ভালো মাস্ক হচ্ছে তিল, সরিষা, জিরা সমপরিমাণে নিয়ে পুরো শরীরে ও মুখে মাখতে পারেন। এ ছাড়া পাকা টমেটো দিয়ে কিছুক্ষণ ম্যাসেজ করে ধুয়ে ফেলতে পারেন। বাজারে ক্যালামাইলিন লোশন পাওয়া যায়। রোদে পোড়া ত্বকে রাতে লাগালে ভালো ফল পাওয়া যায়। ঠোঁটের ক্ষেত্রে লেবু ও মধু মিশিয়ে সকাল ও বিকেলে ম্যাসেজ করতে পারেন। লিপস্টিক হিসেবে দিনে সান প্রোটেকশনসহ লিপস্টিক ব্যবহার করুন। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে ভেজা ঠোঁটে পেট্রোলিয়াম জেলি লাগিয়ে নিন। আর সকালে ব্রাশ করার সময় নরম ঠোঁটে ব্রাশ দিয়ে হালকা করে ঘষে মৃত চামড়াটা তুলে ফেলুন। এরপর পেট্রোলিয়াম জেলি মাখুন। যাঁদের চোখের নিচে কালি পড়ে, তাঁরা হরীতকী, আমলকী, বয়রা—এ ত্রিফলের গুঁড়া মিশিয়ে লাগাতে পারেন। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে তিলের তেল দিয়ে হালকা ম্যাসেজও উপকারী।
এ সময় ধুলাবালি আর রোদের উত্তাপে চুলগুলো হয়ে ওঠে রুক্ষ। অনেকের চুল পড়াও শুরু হয় শুষ্কতার কারণে। তাই চুলের যত্নের দিকে মনোযোগ দিতে ভুল করবেন না।
আমলকী গুঁড়া চুলে লাগাতে পারেন।
তেল ও লেবুর রস মিশিয়ে রাতে ম্যাসেজ করুন মাথার ত্বকে। সকালে ধুয়ে ফেলুন।
সবুজ ধনেপাতার রস চুলের গোড়ায় লাগালে চুল পড়া বন্ধ হয়।
শিকাকাই গুঁড়া চুলের জন্য উপকারী। পানিতে মিশিয়ে লাগিয়ে ১৫ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন।
মেহেদির রস ও পেঁয়াজের রস লাগিয়ে ২০ মিনিট রাখতে পারেন। আপনি চাইলে বাজারের শ্যাম্পু-কন্ডিশনারের পরিবর্তে ঘরে বসেও প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে কাজ সারতে পারেন।
রাতে রিঠা ভিজিয়ে রাখুন। সকালে পানিটা ছেঁকে শ্যাম্পু হিসেবে ব্যবহার করুন।
৩০ মিনিট সরিষার খৈল ভিজিয়ে রেখে তা শ্যাম্পু হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন।
কন্ডিশনার হিসেবে চায়ের লিকার ঠান্ডা করে শ্যাম্পুর পর ১০ মিনিট চুলে রেখে ধুয়ে ফেলতে পারেন।
রাতে মেথি গুঁড়া ভিজিয়ে রেখে ছেঁকে সকালে সেটা কন্ডিশনার হিসেবে ব্যবহার করুন।
যেহেতু এ সময় রোদের তাপ বেশি, তাই বাইরে বের হওয়ার সময় চুলে একটা স্কার্ফ পেঁচিয়ে নিন। রাহিমা সুলতানা বলেন, ত্বকের ও চুলের সৌন্দর্যের জন্য খাবারটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ৮০ ভাগই খাওয়ার পুষ্টি এবং মাত্র ২০ ভাগ বাইরের যত্নের ওপর সৌন্দর্য নির্ভর করে। তাই খাবারের দিকে খেয়াল রাখুন।
ভিটামিন এ ও ই-সমৃদ্ধ সবজি, ফলমূল খান, পান করুন প্রচুর পানি। একটু সময় বের করে প্রতিদিন করতে পারেন যোগব্যায়ামও। এর ফলে শরীর ও মনের মধ্যে ভারসাম্য আসে; ঘুম ভালো হয়। চিন্তাটা আজ থেকে কমিয়ে দিন। হাসতে কৃপণতা কেন করবেন? হাসুন প্রাণ খুলে। আপনাকে এমনিতেই অনেক সুন্দর দেখাবে। বলুন তো আর কী চাই?
শান্তা তাওহিদা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ২৩, ২০১০
Leave a Reply