প্রায় ১২০ কিলোমিটার লম্বা বলে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত বিশ্বের দীর্ঘতম অবস্থানে। আর তাই এই সৈকতের প্রাকৃতিক রূপ উপভোগ করার জন্য ছুটে আসেন পর্যটকেরা, বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে। ১২ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার। বেলা ১১টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই সমুদ্রসৈকতে মনে হচ্ছিল যেন নেমে এসেছিল দেড় শতাধিক পরি। ১৮টি নৃগোষ্ঠীর তরুণীদের ঐতিহ্যবাহী নাচেগানে সেদিন ভরপুর ছিল পুরো সৈকত। হাজার হাজার দর্শক দেখতে পেলেন একসঙ্গে এত ভাষার, ভিন্ন চেহারা ও পোশাকের মানুষ। সেদিনের নীল জলের বিশাল সাগরতট যেন আদিবাসীদের এক মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল।
তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান এবং ঢাকা, সিলেট, কক্সবাজার, রাজশাহী, দিনাজপুর, মৌলভীবাজারসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসেছিলেন তাঁরা। আদিবাসী নৃগোষ্ঠী চাক, কেয়াং, খুমি, ত্রিপুরা, মারমা, লুসাই, তাঁত, মুরুং, তংচইঙ্গা, বম, পাংখোয়া, রাখাইন, বৈশালী, খাসিয়া, মনিপুরি, চাকমা, গারোসহ ১৮টি সম্প্রদায়ের দেড় শতাধিক তরুণ-তরুণী বৈচিত্র্যপূর্ণ নানা ভাষা, নানা ঐতিহ্যবাহী পোশাকে নেচেগেয়ে দর্শকদের আনন্দ জোগান। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন এবং বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আই আদিবাসীদের নিয়ে এই সৈকতের লাবণী পয়েন্টে আদিবাসী মেলার আয়োজন করে। এর আগে প্রথম আদিবাসী মেলা হয়েছিল সৈকতের শৈবাল পয়েন্টে ২০০৯ সালের ৩০ জানুয়ারি।
বেলা সাড়ে ১১টায় প্রথম মঞ্চে ওঠেন আদিবাসী মারমা সম্প্রদায়ের তরুণীরা। ঐতিহ্যবাহী পোশাকে সজ্জিত মারমা তরুণীরা পাখানৃত্য পরিবেশন করেন। এরপর ফাগুনকে স্বাগত জানিয়ে করেন প্রজাপতি নৃত্য। এরপর মঞ্চে ওঠেন কক্সবাজারের রাখাইন তরুণীরা। পরনে তাঁদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক থামি-ব্লাউজ। দর্শকদের বিপুল করতালি। সম্ভবত স্বাগতিক জেলার বাসিন্দা বলে।
‘দুই হাজার বছর আগে অর্থাত্ বৈশালী যুগে তরুণ-তরুণীরা নেচেগেয়ে রাজা আনন্দ চন্দ্রকে বরণ করেছিল। আজ সেই বৈশালী নৃত্য দেখাল আজকের রাখাইন তরুণীরা।’ বললেন রাখাইন নৃত্যপরিচালক ক্যা মং রাখাইন। তারপর রাখাইন তরুণীরা তাঁদের নববর্ষ সাংগ্রাং উত্সবে গাওয়া পানিখেলা নৃত্য, রশিটানা নৃত্য ও বুদ্ধরত্ন বন্দনা নৃত্য পরিবেশন করে দর্শকদের মাতিয়ে রাখেন।
এরপর আসেন বান্দরবানের পাংখোয়া তরুণ-তরুণীরা। তাঁরা বছরের প্রথম জুম চাষের ফসল তোলার আনন্দের গান পুষ্পনৃত্য পরিবেশ করেন। তারপর একে একে রাঙামাটির চাকমা তরুণীদের বোতল নৃত্য, খাগড়াছড়ির মারমা তরুণীদের পাখানৃত্য, সিলেটের খাসিয়াদের পান চাষ নিয়ে নৃত্য, রাখাইনদের ময়ূর নৃত্য, বমদের শিকারি নৃত্য, ত্রিপুরা তরুণীদের বিয়ের অনুষ্ঠানে পরিবেশিত নৃত্য, চাকমা তরুণ-তরুণীদের পাহাড়ের গায়ে জুম চাষ নিয়ে ময়ূর নৃত্য, মারমা তরুণ-তরুণীদের মাছ শিকারের পরে আনন্দের নৃত্যগান, লুসাই তরুণ-তরুণীদের বাঁশনৃত্য দর্শকদের মুগ্ধ করে।
মোট কথা, ১৮টি জাতিসত্তার আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রায় দেড় শতাধিক শিল্পী তাঁদের ঐতিহ্যবাহী নাচ-গান, শিল্প-সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, বর্ণমালা, বর্ণিল ছবি, স্বতন্ত্র গল্পগাথা, ইতিহাস দর্শকদের সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। এ জন্য পাহাড়ি মানুষও কম খুশি না।
ক্যা মং রাখাইন বলেন, ‘মেলাকে কেন্দ্র করে আমরা কয়েক দিন ধরে নানা প্রস্তুতি নিয়ে আসছি। যেন অনুষ্ঠানে ভালো নৃত্যগান উপহার দেওয়া যায়।’
এরপর শুরু হলো ছবি তোলঅর পালা। প্রথমে রাখাইন তরুণিরা এগিয়ে এলেন। ক্যামেরার সামনে তাঁদের নানা ভঙ্গি দেখে ছবি তুলতে এলেন চাকমা, মারমা, লুসাই, মুরং, খাসিয়াসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের তরুণীরা। রোদে পোড়া তপ্ত বালুচরে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা হচ্ছে। আয়োজকদের একজন তরুণীদের অবস্থা দেখে চোখ মাথায় তুললেন। বললেন, ‘হায় হায়! এই গরমে…মেকআপ নষ্ট হয়ে যাবে। এসো, সবাই এসো, মঞ্চে উঠতে হবে, গাইতে হবে। নাচতে হবে না তোমাদের?’
মারমা এক তরুণী উত্তরে বললেন, ‘নাচব, গাইব, সব হবে। তার আগে কয়েকটা ছবি তুলে নিই। প্লিজ, একটু পরে আসছি।’
বেলা সাড়ে ১১টায় বেলুন উড়িয়ে মেলা উদ্বোধন করেন শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া। মেলার আমেজের সঙ্গে মিল রেখেই বোধহয় তিনি এসেছিলেন টুকটুকে লাল শার্ট পরে। ‘দশম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালে প্রথম এসেছিলাম এই সৈকতের বেলাভূমিতে। তখন সাগর-পাহাড়ের রূপ দেখে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। আর আজ? নানা ভাষার নানা পোশাকের সুন্দর মুখগুলো দেখে নিজেকে দ্বিতীয়বারের মতো হারিয়ে ফেললাম।’ এভাবেই শুরু করলেন তাঁর বক্তব্য। তিনি বলেন, ‘বাঙালি জাতিসত্তার সাথে মিশে আছে আরও ৩৫টি আদিবাসী গোষ্ঠী। এরা বাংলাদেশের সৃজনশীল চেতনাকে সমৃদ্ধ করছে। এরা আমাদের গর্বিত নাগরিক। এদের ঐহিত্য-সংস্কৃতিকে লালন ও বিকশিত করে গড়ে তুলতে হবে অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক বাংলাদেশ।’
চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর বলেন, ‘নতুন বাংলাদেশ তৈরির জন্যই আদিবাসীদের নিয়ে আমাদের এই উত্সব। চ্যানেল আইয়ের মাধ্যমে ছয়টি মহাদেশের লাখো কোটি দর্শক আদিবাসীদের এই নাচগান উপভোগ করে। পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে এই উত্সব কি কম ভূমিকা রাখছে?’
ঢাকার মিরপুর থেকে আসা পর্যটক সৈয়দ আবদুল মান্নান বলেন, ‘নানা ভাষা, নানা ধরনের পোশাক আর এত বেশি রঙের সমাহার একসঙ্গে আগে কোথাও দেখিনি। পাহাড়চূড়া থেকে নেমে আসা পরিদের মিলনমেলায় সাধারণ মানুষ কেন, সাগরের গর্জনও কিছুক্ষণের জন্য থেমে গিয়েছিল।’
সিলেট থেকে আসা মনিপুরি তরুণীরা বলেন, ‘আমরা আলাদা জাতিসত্তা এবং সম্প্রদায়ের মানুষ হলেও এক দেশ এক মাটিতে বসবাস করি। আমাদের পতাকা একটি। আমরা বাংলাদেশি। এই নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। আমরা সবাই বাংলাদেশের সুনাম ছড়িয়ে অগ্রগতি অর্জনের পথে এগোচ্ছি। এই সৈকতে পাহাড়ের মিলনমেলা তা কি প্রমাণ করে না?’
আব্দুল কুদ্দুস
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ২৩, ২০১০
Leave a Reply