হৃদরোগ হিসেবে অ্যানজিনা পেকটোরিস সংক্ষেপে ‘বুকব্যথা’ হিসেবে পরিচিত। হৃদযন্ত্রের ধমনিতে ব্লকেজ থাকলে রক্ত চলাচল বাধাপ্রাপ্ত হয় বলে বুকে এই ব্যথা অনুভূত হয়। করোনারি আর্টারি বাইপাস সার্জারি বা গ্রাফটিং হলো সেই পদ্ধতি, যার মাধ্যমে রোগীর পায়ের শিরা কেটে নিয়ে হার্টের ব্লক হয়ে যাওয়া ধমনির বিকল্প পথ তৈরি করে দেওয়া হয়, যাতে হৃৎপিণ্ডের ধমনিতে রক্ত চলাচল অব্যাহত থাকে। হৃদরোগ চিকিৎসায় বেলুনিং বা এনজিওপ্লাস্টি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বাইপাস বা এনজিওপ্লাস্টি ছাড়াও ভিন্ন উপায় আছে, যা অত্যন্ত নিরাপদ ও স্বল্পব্যয়ী। এর নাম চিলেশন থেরাপি। একবার এই থেরাপিতে অভ্যস্ত হওয়ার পর বহু হৃদরোগীই আর অপারেশনে সম্মতি দেন না। সে প্রয়োজনই আর হয়নি। বাইপাস সার্জারির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে এমন কিছু রোগীকে, যাদের অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটেছে বা যাদের তাৎক্ষণিক ঝুঁকি ছিল, হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। তাই হৃদরোগ প্রতিরোধের জন্য চিলেশন থেরাপিকে অনেকেই অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। যারা একবার অপারেশন করিয়েছেন তাদের যেন দ্বিতীয়বার অপারেশন করতে না হয়, সে কারণেও এই থেরাপির কথা জোরালোভাবে বলা হয়।
এক বা দুই ব্লকেজের জন্য এনজিওপ্লাস্টি এবং একাধিক ব্লকেজের জন্য বাইপাস সার্জারির চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু যখন সেই ব্লকেজের সংখ্যা অনেক হয় তখন? ব্যথা হলে আমরা এসপিরিন গ্রহণ করে থাকি। বাইপাস সার্জারি অত্যন্ত ব্যয়বহুল এক সার্জিক্যাল এসপিরিনের সঙ্গে তুলনীয়। যন্ত্রণা দূর হয় বটে, কিন্তু রোগ নির্মূল হয় না।
‘আমি কোনটা বেছে নেব?’ এটা রোগীদের একটা সাধারণ প্রশ্ন। ডাক্তারের আর কোনো পরামর্শ নেই।
ধমনিতে মিশে যেতে পারে এমন ওষুধ, যেমন নাইট্রোগ্লিসারিন এনজিনা বা বুকের ব্যথা সারাতে সাহায্য করে। তবে রক্ত যাদের পাতলা, অর্থাৎ হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কম, তাদের জন্য এটা বিপদ ডেকে আনতে পারে। বেটা ব্লকারস ও ক্যালসিয়াম এন্টাগনিস্ট কিছু উপকারে আসে, যদিও এর গ্রহণযোগ্যতা শাশ্বত নয়। আর সত্যি বলতে কি, এর ভেতর সবচেয়ে শক্তিশালী যেটি-চিলেশনের নাম কেউ উল্লেখই করেন না।
চিলেশন থেরাপি বিনা অপারেশনের একটি চিকিৎসা-পদ্ধতি, যা মেটাবলিকের উন্নতি ঘটায় এবং নানাভাবে রক্তসঞ্চালন প্রক্রিয়াকে গতিশীল রাখে। একই সঙ্গে দেহে ধাতব আয়নে সামঞ্জস্য নিয়ে আসে, ক্ষতিকর পদার্থ বের করে দেয়। এই থেরাপির জন্য ব্যয়বহুল হাসপাতালে ভর্তি হওয়া লাগে না, ডাক্তারের চেম্বারেই গ্রহণ করা সম্ভব।
সম্ভবত চিকিৎসাবিজ্ঞানে যেসব বিষয় অত্যন্ত গোপন রাখা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে চিলেশন থেরাপি অন্যতম। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যেসব রোগী হৃদরোগের বিকল্প চিকিৎসা হিসেবে এই চিলেশন থেরাপি গ্রহণ করেছে, তাদের সাফল্যের হার খুবই সন্তোষজনক। এই থেরাপি লাখ লাখ মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে, যারা বয়সজনিত বিভিন্ন ব্যাধিতে ভুগছিলেন।
বিজ্ঞানীরা একপর্যায়ে এই থেরাপির ফলে ভিটামিন ‘সি’ ও ‘ই’, সেলেনিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, জিঙ্ক, বেটা ক্যারোটিনসহ অন্যান্য উপাদানের সংযুক্তি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হলেন, তখন এসবের বায়োলজিক্যাল অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান বিষয়ে নতুন করে ভাবনা-চিন্তা করলেন। এই সব গবেষণার ফল এল ইতিবাচক এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট-সংক্রান্ত বিবেচনায় চিলেশন থেরাপির গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠিত হলো। আরও উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই থেরাপি কেবল হৃদযন্ত্রের আশপাশের ধমনির জন্যই কার্যকর ভূমিকা রাখে না, দেহের অন্যান্য অংশের ধমনি, এমনকি হাত-পায়ের আঙ্গুল ও মস্তিষ্কের ধমনির জন্যও উপকার বয়ে আনে।
প্রতিবছর ৬০ হাজারের মতো মানুষ তাদের পা হারায় গ্যাংগ্রিনে, ধমনিতে ব্লকেজ সৃষ্টি হয়ে। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে মারা যায় বহু লোক। ঘাড়-মাথা-পায়ের ধমনিতে বাইপাস সার্জারি এখন সাধারণ বিষয় হয়ে গেছে। এর প্রতিটি ক্ষেত্রে কম খরচে ও ঝুঁকিহীনভাবে চিকিৎসা করতে পারে চিলেশন থেরাপি।
ডা· গোবিন্দ চন্দ্র দাস
সিনিয়র কনসালটেন্ট
শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ২০, ২০০৮
Leave a Reply