বার্ড ফ্লু কী
এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা বা বার্ড ফ্লু-পাখির জ্বর, মানুষের নয়। জীবনের কোনো না কোনো সময় ফ্লুতে আক্রান্ত হননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। সিজনাল ফ্লু বা ঋতুভিত্তিক ইনফ্লুয়েঞ্জার অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। বার্ড ফ্লু নতুন অভিজ্ঞতা। বার্ড ফ্লু পাখির অসুখ, পাখির মড়ক; কিন্তু মানুষে হলে আর রক্ষা থাকে না। মারাত্মক ভাইরাস। প্রতিনিয়তই স্বভাব পাল্টায়। সাদামাটা চরিত্রের ভাইরাস স্বভাব বদলে হয়ে উঠতে পারে জীবনঘাতী। বার্ড ফ্লু ভাইরাসও সে রকমই। যেকোনো সময় চরিত্র বদলে মানুষের সংস্পর্শে এসে তৈরি করতে পারে আরেকটি ভয়ঙ্কর প্রজাতির নতুন ভাইরাস-দ্রুত ছড়িয়ে মহামারি তৈরি করতে পারে। সে জন্যই এটি থেকে সতর্ক থাকা এত জরুরি।
ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস
ইনফ্লুয়েঞ্জা পরিবারের ‘এ’ ও ‘বি’ ভাইরাসের রোগতাত্ত্বিক গুরুত্ব বেশি। এদের দুটো অ্যান্টিজেনিক অংশ রয়েছে। দুই ধরনের গ্লাইকোপ্রোটিন। হিমএগ্লুটিনিন (এইচ) ও নিউর্যামিনাইডেজ (এন)। এই গ্লাইকোপ্রোটিনগুলোর কার্যকারিতার ওপর ভিত্তি করে ইনফ্লুয়েঞ্জা ‘এ’ ভাইরাসটিকে ১৬টি ‘এইচ'(ঐ১-ঐ১৬) এবং নয়টি ‘এন’ (ঘ১-ঘ৯) সাব-টাইপে ভাগ করা হয়।
বার্ড ফ্লু থেকে হিউম্যান ফ্লু
ইনফ্লুয়েঞ্জা ‘বি’ সাধারণত মানুষেই হয়। ইনফ্লুয়েঞ্জা ‘এ’ মানুষ ও পাখিতে হয়। বার্ড ফ্লু হয় ‘এ’ ভাইরাস দিয়ে। এর কিছু স্ট্রেইন বা উপপ্রজাতি খুবই মারাত্মক। এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা (এআই) ভাইরাসের মধ্যে আবার কম ক্ষতিকারক ও বেশি ক্ষতিকারক উপপ্রজাতি রয়েছে। এ পর্যন্ত বেশি ক্ষতিকারক বার্ড ফ্লুর প্রাদুর্ভাব হয়েছে এইচ৫এন১ উপপ্রজাতির কারণে। কারণ এই এইচ৫এন১ ভাইরাসটিই এ পর্যন্ত পাখি থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়েছে। বার্ড ফ্লু থেকে হিউম্যান ফ্লুতে আক্রান্ত হওয়ার সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি রয়েছে এই এইচ৫এন১ হাইলি প্যাথজেনিক এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের মাধ্যমে।
ভয়ের কারণ কোথায়
বার্ড ফ্লু মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না। হাঁস-মুরগি থেকে কোনো মানুষে সংক্রমিত হলে সেই মানুষই কেবল এ রোগে আক্রান্ত হয় এবং সময়মতো চিকিৎসা না হলে মারা যায়। হাঁস-মুরগিতে বার্ড ফ্লুর জীবাণু থাকে অন্ত্রে। আর মানুষের মধ্যে যখন আসে তখন এটি মানুষের ফুসফুসে অবস্থান করে। এটা ঢোকে নাক-মুখ দিয়ে। অর্থাৎ সংক্রমিত হাঁস-মুরগি-পাখির বিষ্ঠা থেকে নিঃশ্বাসের সঙ্গে এই জীবাণু ফুসফুসে চলে আসতে পারে। যারা হাঁস-মুরগি ও পাখি লালন-পালন করে, জবাই করে, চামড়া ছাড়ায়, কাটাকুটি করে-তাদের নাক দিয়েও এই জীবাণু ঢুকতে পারে। তীব্র শ্বাসকষ্ট থেকে হতে পারে মৃত্যু। আসল ভয়টা এখানেই।
বার্ড ফ্লু যেভাবে ছড়ায়
ধরুন আপনি বাড়ির আঙিনায় ছোট খোঁয়াড়ে চারটি হাঁস ও চারটি মুরগি পালেন। এগুলো ডিম দেয়, পুষ্টি জোগায়। সকালবেলা হাঁস-মুরগিগুলোকে ছেড়ে দেন। সন্ধ্যায় খোঁয়াড়ে ঢোকান। হাঁসগুলো আশপাশের পুকুরে যায় আর মুরগিগুলো এদিক-ওদিক। এইচ৫এন১ ভাইরাসে আক্রান্ত কোনো বন্য পাখি, সামুদ্রিক বা শীতের অতিথি পাখি উড়ে যাওয়ার সময় বিষ্ঠা ত্যাগ করল পুকুরে, যেখানে আপনার হাঁসগুলো ভেসে বেড়ায়-পানি সংক্রমিত হলো বিষ্ঠা থেকে, হাঁস সংক্রমিত হলো পানি থেকে।
সংক্রমিত হাঁসগুলো থাকে মুরগিগুলোর সঙ্গে একই খোঁয়াড়ে। ফলে হাঁস থেকে মুরগিতে ছড়াল। সকালবেলা খোঁয়াড় খুলে হাঁস-মুরগিকে খাবার দিলেন, ডিম নিলেন প্রতিদিনের মতো। ভাইরাসটি ছড়াল আপনার মধ্যেও। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এভাবেই আক্রান্ত হয় মানুষ। যারা হাঁস-মুরগির খামারে কাজ করে, কিংবা হাঁস-মুরগি বেচা-কেনা, জবাই-ড্রেসিং, কাটাকুটি ও রান্না করে-তারাও আছে ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীতে। আর সে কারণেই পোলট্রিতে মুরগি-নিধন জরুরি হয়ে ওঠে। সংক্রমণ রোধের জন্য ১০ হাজার মুরগির চেয়ে একজন মানুষের জীবনের মূল্য বেশি নয় কি?
নতুন ভাইরাস হতে পারে মহামারির কারণ
এভিয়ান ও হিউম্যান ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস পারস্পরিক মিউটেশনের মাধ্যমে জন্ম দিতে পারে একটি নভেল বা সম্পূর্ণ নতুন ভাইরাসের।
বিগত শতাব্দীতে ১৯১৮, ১৯৫৭ ও ১৯৬৮ সালে এ ধরনের ঘটনায় বিশ্বব্যাপী দেখা দিয়েছিল মহামারি। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এইচ৫এন১ এ ধরনের একটি পটেনশিয়াল ভাইরাস, যা এই শতাব্দীতে জন্ম দিতে পারে একটি নতুন প্যানডেমিকের। একটি মহামারি যখন ভৌগোলিক সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন তাকে প্যানডেমিক বলে। ১৯১৮-১৯ সালে প্যানডেমিক স্প্যানিশ ফ্লুতে (এইচ১এন১) চার কোটি, ১৯৫৭-৫৮ সালে প্যানডেমিক এশিয়ান ফ্লুতে (এইচ২এন২) ২০ লাখ এবং ১৯৬৮-৬৯ সালে প্যানডেমিক হংকং ফ্লুতে (এইচ৩এন২) সাত লাখেরও বেশি মানুষ মারা গেছে গোটা বিশ্বে। বিশ্বব্যাপী এভিয়ান ফ্লু থেকে আরেকটি সম্ভাব্য প্যানডেমিকের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ ধরনের প্যানডেমিক মোকাবিলায় ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে।
শীতের সময়টাতে আসা অতিথি পাখিরা সঙ্গে নিয়ে আসতে পারে বার্ড ফ্লুর ভাইরাস। তাই এখন থেকেই বার্ড ফ্লু প্রতিরোধে সচেতন থাকার বিকল্প নেই।
সতর্ক হোন হাঁস-মুরগি পালনে
— বাড়িতে হাঁস ও মুরগি দুটোই পালন করলে-হাঁস ও মুরগি আলাদা খোঁয়াড়ে রাখুন। ঘরের হাঁস-মুরগির সঙ্গে বনের পাখি বা অতিথি পাখি রাখবেন না।
— যাঁরা বাড়িতে হাঁস-মুরগি পালন করেন, তাঁরা হাঁস-মুরগি ধরা, খোঁয়াড়ে দেওয়া কিংবা ডিম সংগ্রহের পর সাবান দিয়ে বিশুদ্ধ পানিতে হাত ধুয়ে ফেলুন, প্রতিবারই।
— হাঁস-মুরগি মরে গেলে খালি হাতে ধরবেন না বা নাড়াচাড়া করবেন না। পারতপক্ষে রোগাক্রান্ত হাঁস-মুরগি জবাই করা বা পালক ছাড়ানো বা কাটাকুটি থেকে বিরত থাকুন। একান্তই করতে হলে
গ্লাভ্স ব্যবহার করুন। নাক-মুখ ঢেকে রাখুন।
— শিশুরা যাতে হাঁস-মুরগি-কবুতর কিংবা অন্যান্য পাখি নিয়ে খেলা না করে, সেদিকে খেয়াল রাখুন। কোনো শিশু হাঁস-মুরগি-পাখি ধরলে সঙ্গে সঙ্গে ভালোভাবে সাবান দিয়ে হাত ধুইয়ে দিন।
— বাড়ির ছাদে হাঁস-মুরগি পালন করলে খাঁচাগুলো এমনভাবে ঢেকে রাখুন, যাতে উড়ন্ত পাখির বিষ্ঠা সেগুলোয় না পড়তে পারে।
হঠাৎ ফ্লুতে আক্রান্ত হলে
— সাধারণসিজনাল ফ্লুতে আক্রান্ত হলেভয়ের কোনো কারণনেই।
— বার্ড ফ্লু ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়না।
— হাঁস, মুরগি, কবুতর, পাখি লালন-পালনের সঙ্গে জড়িত কিংবা খামারে কাজ করেন, এমন কেউ হঠাৎ ফ্লুতে আক্রান্ত হলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শনিন।
— যেসব এলাকায় ইতিমধ্যে বার্ড ফ্লু শনাক্ত হয়েছে সেখানেকেউ হঠাৎ ফ্লুতে আক্রান্ত হলে,অর্থাৎ জ্বর, সর্দি-কাশি, গায়ে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিলেসঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। রোগ প্রতিরোধের জন্যটামিফ্লু বা অন্যওষুধ চিকিৎসকের পরামর্শঅনুযায়ী সেবন করুন।
ডা· ইকবাল কবীর, জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ১৪, ২০০৮
Leave a Reply