ধূমপানের মারাত্মক ক্ষতিগুলো আমরা কমবেশি সবাই জানি। এত কিছু জেনে-বুঝেও কি বিবেক এরূপ সর্বনাশা কাজে সায় দিতে পারে? পুরোনো যেকোনো অভ্যাস ছাড়তে হলে কিছু না কিছু কষ্ট করতেই হয়। ধূমপান ছাড়ার এই কষ্টের মাত্রা যেহেতু এর ক্ষতির মাত্রার চেয়ে খুবই কম, তাই এ কষ্ট স্বীকার কোনো ব্যাপারই নয়। নেশা যত পুরোনো ও বেশি হয়, তা ছাড়তে হলে সে বিষয়ে তত বেশি মনোযোগী হতে হয় এবং কিছুটা শ্রম দিতে হয়। যেকোনো নেশা ছাড়ার পর থেকে কী কী অসুবিধা হতে পারে, সেগুলো জানা থাকলে তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া সহজ হয়। ধূমপানের নেশা ছাড়তে হলেও কিছু পদক্ষেপ নিতেই হবে। ধূমপান ছাড়লে কী কী উপসর্গ হতে পারে তা জানা থাকলে মনকে সেভাবে প্রস্তুত রাখা যায়। ফলে আস্তে আস্তে সব নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। তাই আসুন প্রথমে এ উপসর্গগুলো জেনে নিই।
কাশিঃ ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার পর প্রথম অবস্থায় ঘন ঘন কাশি হতে পারে। এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বুঝতে হবে ফুসফুস অনেক দিনের জমে থাকা শ্লে্না বের করে দিতে চাইছে। প্রয়োজন বোধ করলে মাঝেমধ্যে বিশেষ করে প্রতিদিন সকালে কিছু শ্লে্না আস্তে আস্তে কেশে বের করে ফেলুন। এতে আরাম বোধ করবেন।
মাথাব্যথাঃ মাঝেমধ্যে অল্প মাথাব্যথা বা মাথা ঝিমঝিম ভাব হতে পারে। মাথাব্যথা উপশম না হয়ে ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।
ক্লান্ত ভাবঃ প্রয়োজনবোধে ঘুমানোর সময় এক থেকে দেড় ঘণ্টা বাড়িয়ে দিন। দিনে পর্যাপ্ত ব্যায়াম করুন। এতে ঘুম ভালো হবে এবং ক্লান্তি ভাব অনেকটা কেটে যাবে।
অমনোযোগিতাঃ পরিমিত ও সময়মতো আহার, ব্যায়াম ও বিশ্রাম করুন। আস্তে আস্তে এ উপসর্গটি দূর হয়ে যাবে।
স্মায়বিক দুর্বলতাঃ প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণ পানি পান করুন। এতে শরীরে জমে থাকা নিকোটিন বেরিয়ে যাবে। ক্যাফেইন অর্থাৎ চা ও কফি পানের মাত্রাও কমিয়ে ফেলুন। ধীরে ধীরে স্মায়ুকোষগুলো নিকোটিনের প্রভাব থেকে মুক্ত হবে। ফলে সন্ত্রস্ত ভাব কেটে গিয়ে সতেজ ভাব ফিরে আসবে।
গলায় ব্যথা বা জ্বালা ভাবঃ শরবত, ফলের রস ও অন্যান্য তরল খাবার খেলে ভালো লাগবে। হালকা গরমপানি দিয়ে গড়গড়া করতে পারেন।
কোষ্ঠকাঠিন্যঃ প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় পর্যাপ্ত আঁশযুক্ত খাবার, সবজি ও তাজা ফল সংযুক্ত করুন। ইসপগুলের ভুসি খাওয়ার অভ্যাস করুন এবং সেই সঙ্গে ব্যায়াম করুন।
ঘুম কম হওয়াঃ ভালো ঘুমের জন্য ভালো উপায় হলো অল্পতে অহেতুক দুশ্চিন্তা না করা, মনকে সদা প্রফুল্ল রাখা এবং নিয়মিত শরীরচর্চা ও খেলাধুলা করা। দু-এক দিন ঘুম না হলে সামান্য কিছু অস্বস্তি ভাব হতে পারে। এ নিয়ে বেশি চিন্তা করবেন না। এমনও অনেক মানুষ আছে, ঘুম কেন হচ্ছে না? এ ভাবনাটাই তাদের ঘুম না হওয়ার বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে মনমরা ভাব ও মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। প্রতিদিন মনের মতো ভালো বই পড়ুন, মন খুলে কথা বলুন ও প্রাণখুলে হাসুন। এতে অনেক ভালো বোধ করবেন।
নিকোটিনের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে একেকজনের ক্ষেত্রে একেক রকম সময় লাগতে পারে। তবে সাধারণত দু-চার সপ্তাহ লাগে। নেশা ছেড়ে দেওয়ার পর বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক প্রতিক্রিয়া যখন শুরু হবে, তখন সেগুলোকে নেশা থেকে মুক্তি পাওয়ার ও সুস্থতা অর্জনের পূর্বলক্ষণ হিসেবে ভাবতে চেষ্টা করুন। মনে করুন আপনার শরীর নিজে থেকেই নিজেকে পরিষ্কার করে নিচ্ছে।
দুই-চার সপ্তাহ পর শারীরিক প্রতিক্রিয়াগুলো থেকে মুক্তি পেলেও ধূমপানের প্রতি যে ব্যাগ্র কামনাটুকু বাকি থাকে, তার প্রায় পুরোটাই মানসিক ব্যাপার। তাই এ সময় মনটা শক্ত রেখে ধূমপানের সর্বনাশা ক্ষতির কথা ভেবে নিজেকে সংযত রাখুন।
ধূমপান ছাড়ার পর কী কী অসুবিধা হতে পারে, সে বিষয়ে জানার পর মনকে সেভাবে প্রস্তুত করে নির্দিষ্ট একটি দিনে ধূমপানের সব উপকরণ, যেমন সিগারেট, দেশলাই-লাইটার, ছাইদানি ছুড়ে ফেলে দিন। ধূমপান ছাড়তে ইচ্ছুক এমন আরও কয়েকজনকে সঙ্গে নিতে পারলে ভালো হয়। খেলাধুলা, ব্যায়াম ও আনন্দ-ফুর্তির মধ্য দিয়ে সময় কাটানোর চেষ্টা করতে হবে। পরিবারের লোকজন, বিশেষ করে স্ত্রী ও সন্তানেরা এ ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারে। যত তাড়াতাড়ি ধূমপান ছাড়া যায় ততই ভালো। অবসর সময়ে এমন কাজে ব্যস্ত থাকুন, যেন মন চাইলেও আপনার হাত সিগারেট ধরানোর সুযোগ না পায়। ধূমপানের বদলে ফলমূল, সবজির সালাদ, ফলের রস, চিনিমুক্ত চুইংগাম ও চকলেট খাওয়ার অভ্যাস করতে পারেন। এভাবে সংখ্যা কমাতে কমাতে সিগারেট একেবারে ছেড়ে দিন। ধূমপানমুক্ত নতুন সমাজ গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখুন।
ডা· মো· মাহফুজুল হোসেন
সহকারী প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংক মেডিকেল সেন্টার, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ১৪, ২০০৮
Leave a Reply