জীবনের চাই স্থিতিস্থাপকতা। ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য। অসুখে পড়লে আরোগ্য লাভের জন্য। এই স্থিতিস্থাপকতা হলো ‘আবেগের পেশি’, যে পেশি গড়ে ওঠে সুঠাম হয়ে, যদি একে ব্যবহার করা হয়, এর চর্চা করা হয়। আর যদি একে অবহেলা করা হয়, তাহলে এটি শুকিয়ে যায়। আবেগের এই পেশি গড়ে তুলতে পারে যে-কেউ। চেষ্টায় সব হয়। প্রত্যেকেরই এই আবেগ-পেশিটা চাই।
কিছু না কিছু স্থিতিস্থাপকতা নিয়ে আমরা প্রত্যেকেই জন্মাই। জীবনে এর প্রয়োগ ঘটানো নিজ নিজ পছন্দ। স্থিতিস্থাপকতা গড়ে ওঠানোর জন্য চাই জ্বালানি, চাই চ্যালেঞ্জ এবং চাই অনেক অনেক চর্চা। অনেকে মনে করে স্থিতিস্থাপকতা এমন এক ধাত, যা জন্মগত। কারও এটি থাকে, কারও থাকে না। তবে এ কথাটি পুরোপুরি সত্য নয়। আমরা কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মাই, যা স্থিতিস্থাপকতা বিকাশে সহায়তা করে। যেমন-ধরুন, মানুষের মেজাজ মানুষকে স্থিতিস্থাপকতা অর্জনে অনেকটাই সহায়তা করে, এমন অনেক মানুষ জন্মায়, যারা চাপে ততটা নতি স্বীকার করে না জন্মগতভাবেই। তাই প্রতিকূল পরিবেশে তারা থাকে অচল, অটল, নুয়ে পড়ে না; আর যেসব পরিস্থিতিতে অন্যরা কাবু হয়ে যায়, সেখানে তাদের বুদ্ধি খুলে যায়।
অনেকে জন্মায় আশাপূর্ণ মনোভাব নিয়ে। অনেকে জন্মায় বহির্মুখী মনোভাব নিয়ে। এর পরও অনেকে আছে, যাদের মনে অনেক অনেক সাহস, ঝুঁকি নেওয়ার শক্তি এদের মনে বেশি। এসব গুণাগুণ, যা ব্যক্তিত্বের জন্মগত উপকরণ বলে মনে করা হয়। এ গুণাবলির প্রভাবে সহজে স্থিতিস্থাপকতা অর্জন করা যায়। তবে সংকল্পের দৃঢ়তা ও চর্চা একজনকে এই স্থিতিস্থাপকতা লালন-পালনে সহায়তা করে। বস্তুত জন্মগত উপহারের চেয়ে বরং শিখে নেওয়ার জিনিস এই স্থিতিস্থাপকতা। তাই কীভাবে এটি গড়ে তোলা যায়?
জীবন যখন শুকিয়ে যায়, বিপর্যয়ের শিকার হয়, তখন নিজের অস্তিত্বকে পুনঃস্থাপিত করতে হয়। নিজেকে বিপর্যয়ের শিকার না ভেবে সমস্যা সমাধানের কৃতী মানুষ হিসেবে ভাবা ভালো।
মগজে যে সুইচটি আছে শুরু করার, একে চালিয়ে দেওয়া চাই।
নিজের দিকে বা নিজের ঘাটতির দিকে নজর দেওয়া নয়। লক্ষ্যের দিকে, কী লক্ষ্য অর্জন করতে হবে সেদিকে নজর দেওয়া চাই। নিজেকে প্রশ্ন করা, ‘কীভাবে করব সমস্যার সমাধান?’
নিজের স্বস্তি ও আরামের অঞ্চলকে অতিক্রম করে কঠিন পথে অগ্রসর হওয়ার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে। ঝুঁকি গ্রহণ করা থেকে নির্মিত হয় স্থিতিস্থাপকতা, আর গ্রহণযোগ্য ঝুঁকি গ্রহণ করা সঠিক কাজ।
দারুণ চাঞ্চল্যকর কোনো খেলায় অংশগ্রহণ করা হতে পারে এমন চ্যালেঞ্জের উদাহরণ। নিজের স্বস্তিকর অবস্থান থেকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনেক উদাহরণ আছে। জীবনসঙ্গীর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে, এ জন্য ভেঙে পড়া কেন? সমঝোতা যাতে হয় নিজেদের মধ্যে, সে চেষ্টা করা চাই। আরও একবার। সন্তান নিয়ে সমস্যা হচ্ছে? ছেড়ে দেবেন না। ্নরণ করতে হবে, কত ভালোবাসেন সন্তানকে!
প্রতিদিন চাপ ও প্রতিকূলতাকে সমস্যা হিসেবে না দেখে নতুন সৃষ্টির সুযোগ হিসেবে দেখতে হবে। আমরা মোকাবিলার কৌশল নির্মাণের স্প্রিংবোর্ড হিসেবে এদের ব্যবহার করব, যা নিজেদের বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা দেবে।
একজন নায়ক বা পথিকৃৎকে বেছে নিন দুঃসময়ে, যিনি বিপর্যয়ের কালে হবেন অনুপ্রেরণার উৎস। তিনি হতে পারেন নিজের পরিবারের কেউ বা কোনো দেশনায়ক বা জ্ঞানী ব্যক্তি বা শিক্ষক। ঘুরে দাঁড়ানোর কাহিনী এবং এসব ঘটনার নায়কদের কথা ভাবুন। জানুন তাঁদের সম্পর্কে। এদের পাওয়ার জন্য বেশি দূর যেতে হয় না। সম্ভাবনার অনেকগুলো পাওয়া যায় গণমাধ্যমে। ইতিহাসের অনেক মহানায়ক, যাঁরা দুঃসময়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন, জনগণের অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁদের কথা ্নরণ করতে হয়।
ঘুরে দাঁড়ানো সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করুন। জেনে নিন সেসব মানুষের কাছে, কীভাবে তাঁরা বিপর্যয়কে অতিক্রম করে বেঁচে উঠেছিলেন। দৈহিকভাবেও তৈরি হন। নিয়মিত ব্যায়াম করলে মনে গড়ে ওঠে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, মনে জোগায় শক্তি। ঘুরে দাঁড়ানো আসলে শক্তির উদাহরণ।
এক মাইল দৌড়াতে মনস্থ করলে দৌড়ে নিন দেড় মাইল। ১০ পাউন্ড ওজন উত্তোলনের প্রস্তুতি নিলে ১৫ পাউন্ড ওঠানোর ইচ্ছা পোষণ করুন। যোগব্যায়ামের ভঙ্গি বাড়তি আরও কিছু সময় ধরে রাখুন। ধৈর্য শিখতে হবে নিজে। ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য বেশি প্রয়োজন কুশলী হওয়া, আবেগপ্রবণ হওয়া নয়। উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার আগে নিজেকে বেশি সময় দিন।
কেউ যদি রূঢ় ব্যবহার করে, তৎক্ষণাৎ এতে প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করবেন না, ঘৃণা প্রদর্শন করবেন না। কী কর্তব্য, তা নির্ধারণের আগে তিনটি গভীর শ্বাস নিন। আবেগ ও কার্য দুটোর মধ্যে ব্যবধান আরও বেশি করার জন্য চেষ্টা চাই। আমরা যত কম প্রতিক্রিয়াশীল হব, তত বেশি হব স্থিতিস্থাপক।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরীর কলম থেকে
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস
বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ১৪, ২০০৮
Leave a Reply