ছুটে চলা গাড়ি থেকে ছিটকে আসা কলি, ক্যাফেতে বন্ধুদের আড্ডা, কানে গুঁজে রাখা হেডফোন, গুনগুনিয়ে সুর তোলা—সবখানেই আছে বাংলা গান। গান শোনা তো অনেক আগে থেকেই তরুণদের শখের তালিকায় ছিল। বাংলা গানের প্রতি তাদের আগ্রহও এখন অনেক বেশি। নিজের ভাষার গান যেন নিজের মনেরই অনেক কাছাকাছি। শহুরে তরুণ বাংলা গান শুনছে না এমন উদাহরণ বোধ হয় এখন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
‘বাংলা গানের অর্থ বুঝে নেওয়াটা সহজ। আমারই ভাষায় গাওয়া হচ্ছে। শুনে তাই মনে হয় যেন একদম আমারই জন্য গাওয়া হচ্ছে। আর বাংলা গানের কথা আর সুর এখন বেশ ভালো হচ্ছে। তাই এখন বাংলা গান বেশি শোনা হয়।’ এভাবেই বললেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আদনান খান।
গানের ধরন নিয়ে কথা না-ই বলি, আসল কথাটা হচ্ছে, আমাদের তরুণেরা এখন বাংলা গান বেশি শুনছে। তার বড় প্রমাণ এফএম রেডিওগুলো। প্রতিটি রেডিওতে সারাক্ষণ বাজছে বাংলা গান। আর তরুণেরা কানে গুঁজে রাখা হেডফোনে শুনছে সেই সব গান। এবিসি রেডিওর প্রধান প্রযোজক গোলাম ফারুক বলেন, তরুণেরা এখন বাংলা গানে ডুবে আছে। প্রতিদিন বাংলা গান বাজানোর জন্য যে পরিমাণ অনুরোধ আসে তার তুলনায় অন্য ভাষার গান শোনার অনুরোধ খুবই কম।
রেডিও চ্যানেল ফুর্তির অনুষ্ঠান এবং বাজারজাতকরণের প্রধান ড্যানিয়াল রহমান বললেন, ‘রেডিও ফুর্তির আজকের জনপ্রিয়তা পুরোটাই বাংলা গানের জন্য। কারণ, ভালো বাংলা গানের প্রচুর শ্রোতা রয়েছে। অনেক গান আমরা বাজাই যেগুলো হয়তো প্রথম প্রথম তরুণদের ভালো লাগে না। কিন্তু গণমাধ্যম হিসেবে আমাদের দায়িত্ব সব রকম বাংলা গান শোনানো ও প্রচার করা। যাতে বাংলা গানের প্রসার আরও বেশি হয়। একটা সময় শুনতে শুনতে সেই গানগুলোও শ্রোতাদের পছন্দ হয়ে যায়। এভাবে সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে বাংলা গান।’
‘শুধু এই সময়ের শিল্পীদের গাওয়া গানই নয়, তরুণেরা এখন শুনছে রবীন্দ্র ও নজরুলসংগীতও। রবীন্দ্র ও নজরুলসংগীত উভয় নিয়েই এখন অনেক নিরীক্ষাধর্মী কাজ হচ্ছে। মাউথ অর্গান, পিয়ানো ব্যবহার করে রবীন্দ্রসংগীতের আবহে পরিবর্তন এনেছেন অর্ণব। শাহানা বাজপেয়ীর কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত তরুণেরা লুফে নিয়েছে। এ সময় অবসকিওর ব্যান্ডে টিপু রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে কাজ করেছেন। ব্যান্ডদল শিরোনামহীনও রবীন্দ্রসংগীতের অ্যালবাম বের করছে। তারা সুর ও বাণী ঠিক রেখে নতুন প্রজন্মের চাহিদার কথা ভেবে সংগীতায়োজন করেছে।
যাতে এখনকার তরুণেরা তাতে আকৃষ্ট হয়, বললেন শিরোনামহীনের ভোকাল তুহিন, ‘এখনকার ছেলেমেয়েরা গান শুনে তার অর্থ ও বাণী বুঝতে যেন একটু দ্বিধায় পড়ে যায়। আমরা তাদের আর দ্বিধায় না ফেলে রবীন্দ্রনাথের গানগুলো আমাদের ঢঙে শোনাতে চাই। তাহলে তারা দ্রুত এর সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারে। গানের মধ্য দিয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগটা আরও সহজ হয়।’ ব্যান্ডদল আর্টসেল কিছু দিন আগে প্রকাশ করেছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’ গানটি। সামনে ব্যান্ডের সদস্যদের ইচ্ছে আছে নজরুলসংগীতের পুরো একটি অ্যালবাম করার। আর্টসেলের সদস্যদের মতে, বাংলা গানের প্রতি তরুণদের আগ্রহের মূল কারণটা কিন্তু ভাষার জন্যই।
লোকগান শোনার প্রতি তরুণদের আগ্রহ তো এখন তুঙ্গে। এখনো মনে পড়ে তপন চৌধুরীর গাওয়া ‘কান্দো ক্যানে মন…’ গানটির কথা। আশির দশকে চাইম ব্যান্ডদল গেয়েছিল বিজয় সরকারের গান। লোকগীতির আঙ্গিকে এরপর অনেক শিল্পীই গান করেছেন। নতুন নতুন যন্ত্রের সঙ্গে নতুন প্রাণে নতুন স্বাদে জেগে উঠেছিল লোকগান। তরুণদের সেই উত্সাহ আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দেয় ফিডব্যাক ব্যান্ডের বাউলিয়ানা আর দেহঘড়ি। পরবর্তী সময়ে বাংলা, লালনের মতো ব্যান্ডদল যাত্রা শুরু করে লোকগানের অ্যালবাম দিয়ে। পুরোনো লোকশিল্পীদের গান আবার নতুন করে গাওয়া প্রসঙ্গে বাংলা ব্যান্ডদলের সদস্য আনুশেহ আনাদিল বলেন, ‘গান গাইবার স্বাধীনতা তো আমাদের ছিলই। কেউ বলতে পারবে না আমরা গান বিকৃত করেছি। আমাদের গান তাই সবাই গ্রহণ করেছে।’ আইয়ুব বাচ্চু অ্যালবাম করেন আব্দুল আলীমের গান নিয়ে। শাহ আব্দুল করিমের গান নিয়ে দলছুট আর বাউল কালামিয়ার গান নিয়ে আসিফ অ্যালবাম করেন। আর হাবিব তো কৃষ্ণ আর মায়া অ্যালবাম দিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন নতুন প্রজন্মকে। শাহ আবদুল করিমসহ অনেক বাউলের গানগুলো নতুন যন্ত্রানুষঙ্গে উপস্থাপন করেছেন তিনি। হাবিবের মতে, ‘আমাদের লোকসুরের আবেদন চিরন্তন। আর আমি এই মাটির আওয়াজকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চাই।’ আর সেই কাজে হাবিব যে সফল হয়েছেন তা বোঝা যায় তাঁর করা লোকগানের জনপ্রিয়তা দেখে।
বিভিন্ন ক্যাফে, ফ্যাশন হাউসে ঢুকলেও এখন শোনা যাচ্ছে বাংলা গান। আর এটা করা হচ্ছে শ্রোতাদের পছন্দের কথা মাথায় রেখে। নানা খাবারের ক্যাফে বা লাউঞ্জে নিয়মিত আয়োজন করা হচ্ছে বাংলা গানের আসর। নবীন থেকে প্রবীণ সবাই গাইছেন এ আসরগুলোতে। বেশির ভাগ সময়ই তিল ধারণের জায়গা থাকে না গানের আসরগুলোতে। এ রকম আসরগুলোতে নিয়মিত গাইতে দেখা যায় মিনার রহমানকে। তাঁর কথায়, ‘এখন এত ভালো বাংলা গান হচ্ছে যে শ্রোতাদের না শুনে উপায় নেই। আর গায়ক হিসেবে নয়, এ প্রজন্মের তরুণ হিসেবে আমি অর্ণব, তাহসান, হাবিবের গান মুগ্ধ হয়ে শুনি। আর একই অবস্থা আমার বন্ধুদেরও।’
আমাদের সংগীতে ধারাবাহিকভাবে বিবর্তন ঘটছে। আর তরুণেরা তা গ্রহণ করছে আগ্রহ ভরে। আমরা খেলায় জিতলে চিত্কার করতে পারি, প্রতিবাদ জানাতে গলা ফাটাতে পারি, তাহলে কেন চিত্কার করে গান গাইতে পারব না? বাংলা গান আমরা যেভাবেই গাই না কেন, এটা আমাদের নিজের গান। মায়ের ভাষার গান। জয়তু বাংলা গান।
সুমন পাটওয়ারী
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ০২, ২০১০
Leave a Reply