ডাঃ শাশ্বতী সিনহা
কোভিডের সঙ্গে যুদ্ধটা শুরু হয় মার্চ ২০২০-তে। তার আগে কিছুই জানতাম না, এই ভাইরাস ঠিক কতটা ভয়ঙ্কর? রোজ শুনতাম, একটা ভাইরাস আসছে, সারা পৃথিবীকে কুপোকাত করে দেবে। তখন আমরা কিছু জানতাম না। কীভাবে রোগীর চিকিৎসা করতে হয়? কখন-কোন ওষুধটা দিতে হবে? ঠিক কী করলে রোগীকে ভাইরাস মুক্ত করতে পারব? কিছুই জানতাম না। শুনতাম, কীভাবে রোগীর চিকিৎসা করতে হয়, সেই ধারনাটাই নাকি বদলে দেবে! প্রথম দিকে তাই খুবই ভয় পেয়েছিলাম।
আমার হাতে প্রথম রোগী। যিনি আমার কাছে, গোটা টিমের কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। তখন এক এক করে শিখতে শুরু করলাম। কীভাবে পিপিই পরতে হয়,? কীভাবে ফেস শিল্ড পরে রোগীর চিকিৎসা করতে হয়? সবটাই নতুন করে শিখতে বসলাম। প্রথম রোগীকে নিয়ে আমরা ৪২ দিন লম্বা যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে যাই। তাঁকে সুস্থ করে দিয়ে যখন পরিবারের হাতে তুলে দিলাম, সেটা আমাদের টিমের জন্য একটা বিরাট অ্যাচিভমেন্ট ছিল। আর সেখান থেকে দীর্ঘ যুদ্ধে লড়াই করার সাহস পেয়ে গেলাম। তারপর থেকে এখনও পর্যন্ত ১৫ টা মাস ধরে আমরা লড়াই করে চলেছি। তবে এই লড়াইয়ে সব সময় জিতেছি, এমনটা নয়। অনেকবার হার মানতে হয়েছে করোনার কাছে। অনেককে হারিয়েছি আমরা। কম বয়সি থেকে বেশি বয়সের বহু রোগীর মৃত্যু দিনের পর দিন চোখের সামনে দেখেছি। রোজকার মৃত্যু ও সুস্থ হওয়ার সংখ্যা মাথার মধ্যে যেন কিলবিল করত। হাতে ধরে অগণিত মৃত্যু দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে উঠতাম। এঁদের বাঁচাতে আমরা অনেক চেষ্টা করেছি। প্রতিনিয়ত ছুটে গিয়ে তাঁদের ধিক ধিক করে জ্বলে থাকা প্রাণটাকে উজ্জ্বীবিত করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু, হার মানতে হয়েছে।
একজন রোগী আমাদের চোখের সামনে থেকে যখন চলে যায়, তখন আমাদের মধ্যে থেকেও কিছুটা কিছুটা করে নিয়ে যায়। এটাই বুঝেছি, এই ভাইরাসটাকে হালকাচ্ছলে নেওয়া উচিত নয়। এটা কীভাবে যে রোগীদের জীবন, তাঁদের পরিবার, সন্তানের জীবনকে ছারখার করে দিতে পারে তা শেষ ১৫ মাস ধরে দেখছি।
আমাদের এখানে ভর্তি ছিলেন একজন যুবতী। তার ব্রেস্ট ক্যান্সার ছিল। তবে সুস্থ হয়ে যেতেন। কিন্তু সেই পথে কাটা হয়ে দাঁড়াল করোনা। হঠাৎই শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। রোজ আমাদের কাছে কাতর অনুরোধ জানাত, ‘আমি সুস্থ হয়ে যাব তো?’ ‘মেয়ের কাছে ফিরতে পারব তো?’। কিন্তু যত দিন যেতে লাগল রোগী আরও ক্রিটিকাল হতে থাকল। আমরা অনেক চেষ্টা করলাম। সবদিক থেকে চেষ্টার ত্রুটি রাখলাম না। আমরা প্রতিনিয়ত ওকে সাহস দিতাম। তুমি বাঁচবে, ফিরতে তোমায় হবেই। কিন্তু এমন পরিস্থিতি হল! আমরা ওঁকে মেয়ের কাছে ফেরাতে পারলাম না। বিগত কয়েক মাস ধরে আমাদের মন মস্তিষ্কের মধ্যে যে কঠিন লড়াই চলছে, তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন।
‘ব্রেকিং দ্য ব্যাড নিউজ’, এটা আমাদের প্রফেশনের একটা অঙ্গ। কিন্তু এই মহামারি পরিস্থিতিতে যে কত খারাপ খবর আমাদের পরিবারের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের দিতে হয়েছে, তার হিসেব নেই আমার কাছে।
কিছুদিন আগে আমাদের হাসপাতালে একই পরিবারের ৩ জন ভর্তি ছিলেন। যার মধ্যে থেকে একজনকে (বাড়ির মেয়েকে) বাঁচাতে পেড়েছি। সেটাও খানিকটা হলেও তৃপ্তি ছিল। কিন্তু তাঁর কাছে দুটো মৃত্যু সংবাদ তুলে ধরা যে কি কঠিন মুহূর্ত! এখনও চলছে লড়াই। অনুভূতি গুলোকে এড়িয়ে লড়ে যেতে হবে।
Zee24Ghanta: Health News
2021-07-01 20:48:47
Source link
Leave a Reply