এক বছরের ওপরে বয়স, এমন শিশুদের বারবার কাশি বা শ্বাসকষ্ট হলে বা বুকে শব্দ হলে আমরা মনে করি তার হাঁপানি হয়েছে। বড়দের তুলনায় এক থেকে ১৫ বছরের শিশুরাই এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। এ দেশের মানুষের মধ্যে হাঁপানি ও চিকিৎসা নিয়ে ভুল ধারণা আছে।
বংশগত ধারা ও পরিবেশ হাঁপানিকে নিয়ন্ত্রণ করে। মা-বাবা, ভাইবোন ও নিকটাত্মীয়ের হাঁপানি থাকলে শিশুর হাঁপানি হতে পারে। বংশগতভাবে শিশুর শ্বাসনালি কোনো জিনিসের প্রতি অতিমাত্রায় সংবেদনশীল হলে কাশি বা শ্বাসকষ্ট হয়। বলা যায়, এটা শ্বাসনালির এক ধরনের অ্যালার্জি। ঘরের ও বাইরের কিছু জিনিসের প্রতি অ্যালার্জি থাকতে পারে।
ঘরের ধুলা, ঝুল, কুকুর বা বিড়ালের রোম, মলমূত্র, কার্পেটের ধুলা, শীতাতপনিয়ন্ত্রক যন্ত্রের বাতাসে আবদ্ধ থাকা ছত্রাক, ছারপোকা, তেলাপোকা এবং বিভিন্ন ধরনের খাদ্য, যেমন-গরুর মাংস, চিংড়ি মাছ, ইলিশ মাছ, হাঁসের ডিম, সামুদ্রিক খাবার, গরুর দুধ, বাদাম ও কিছু সবজি।
ফুলের রেণু বা ঘাসের রেণু, সিগারেট বা তামাকের ধোঁয়া, প্রসাধনীর সুগন্ধি, মসলা, গাড়ির বা শিল্প কারখানার ধোঁয়া শিশুর হাঁপানি বাড়িয়ে দিতে পারে। এ ছাড়া শিশুর সামনে ধূমপান করলে, ভাইরাসে শ্বাসনালি সংক্রমিত হলে, শীতের অতিরিক্ত ঠান্ডা বাতাস লাগলে, আবহাওয়ার পরিবর্তনের সময়, বৃষ্টি বা মেঘলা দিন, যখন বাতাসে আর্দ্রতা বেশি থাকে, কোনো কারণে শিশুর দুশ্চিন্তা হলে বা বিষণ্ন থাকলে শিশুর হাঁপানির প্রকোপ বাড়ে।
অনেকে মনে করে, হাঁপানি একটি ছোঁয়াচে রোগ। আসলে হাঁপানি ছোঁয়াচে রোগ নয়। যদি শিশুর হাঁপানি হয়েও যায়, তাহলে মন খারাপ করবেন না। শিশুবয়সের হাঁপানি অনেক সময়ই বড় হলে ভালো হয়ে যায়।
কী করবেন
–ছয় মাস পর্যন্ত শিশুকে বুকের দুধ দিন।
–ছয় মাস থেকে অন্যান্য খাবার দিন এবং খাবারে লবণ কম দিন।
–শিশুকে খেলাধুলায় উৎসাহিত করুন।
–পর্যাপ্ত বাতাস আসার জন্য ঘরের দরজা-জানালা খুলে রাখুন।
–শিশুর ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
–গোসল করালে হাঁপানি বেড়ে যায় না। শিশুকে প্রতিদিন গোসল করান, শীতকালে কুসুম গরমপানি ব্যবহার করুন।
–কলা বা কমলা খেলে হাঁপানি বেড়ে যায়, এ কথাও ঠিক নয়। বরং ভিটামিন ‘সি’ শিশুকে ঠান্ডা লাগা থেকে রক্ষা করে।
–অনেক সময় চিকিৎসার স্বার্থেই নেবুলাইজার বা ইনহেলার ব্যবহার করতে হয়। অনেকে মনে করে, এতে শিশু অভ্যস্ত হয়ে যাবে বা শিশুর ক্ষতি হবে। এটিও ঠিক নয়। চিকিৎসার স্বার্থেই শিশুকে আরাম দেওয়ার জন্য ইনহেলার প্রয়োজন।
–বারবার হাঁপানির লক্ষণ দেখা দিলে নিয়মিত ওষুধ ব্যবহার করতে হবে। এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। প্রয়োজনে ইনহেলার ব্যবহার করুন।
কী করবেন না
–ঘরে অতিরিক্ত আসবাবপত্র, কার্পেট রাখবেন না। পালকযুক্ত পোশাক বা খেলনা শিশুকে দেবেন না।
–কুকুর, বিড়াল ঘরে পুষবেন না।
–ধোঁয়া, ধুলা, ফুল বা ঘাসের রেণু আছে, এমন স্থানে শিশুকে নিয়ে যাবেন না।
–শিশুর সামনে বা পাশে বসে ধূমপান করবেন না।
–শিশুকে তিন ঘণ্টার বেশি কম্পিউটার বা টেলিভিশনের সামনে বসতে দেবেন না।
–শিশুর খুব বেশি মন খারাপ হয়-এ রকম আচরণ করবেন না।
–উপরোল্লিখিত পরামর্শ মেনে চললে এবং সময়মতো ওষুধ খাওয়ালে রোগটি নিয়ন্ত্রণে থাকে।
–সর্দি-কাশিতে অপ্রয়োজনে ওষুধ খাওয়া যাবে না।
–হাঁপানি অ্যান্টিবায়োটিকে ভালো হয় না। তাই শ্বাসকষ্ট হলেই এ-জাতীয় ওষুধ খাওয়ানো যাবে না।
–শ্বাসকষ্টের জন্য ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলে ঘুমের ওষুধ শিশুকে খাওয়াবেন না।
–যেসব খাবার শিশুর হাঁপানি বাড়ে, সেগুলো খাওয়ানো থেকে বিরত থাকুন। অ্যালার্জি হবে বা হাঁপানি বেড়ে যাবে ভেবে সব খাবার বন্ধ করে দেবেন না। এতে শিশু দুর্বল হয়ে পড়বে। শিশুর বাড়ন্ত শরীরের জন্য সব খাবারই প্রয়োজন। খেয়াল করুন, কোন খাবারে অ্যালার্জি হয়, শুধু সেটিই বন্ধ রাখুন। যেকোনো খাবার খাওয়ার কয়েক মিনিট থেকে এক ঘণ্টার মধ্যে যদি হাঁপানি বেড়ে যায়, তাহলে ওই খাবারটি শিশুকে দেওয়া যাবে না।
কখন শিশুকে হাসপাতালে নিতে হবে
–খুব বেশি কাশি হলে, বিশেষ করে রাতের বেলায় কাশি বাড়লে এবং এক মাসের বেশি সময় ধরে কাশি থাকলে।
–বুকের দুধ টেনে খেতে কষ্ট হলে বা অন্যান্য খাবার খেতে অসুবিধা হলে।
–বুকের পাঁজরের নিচের দিক ভেতরের দিকে দেবে গেলে।
–অস্থিরতা থাকলে।
–কাশি বা শ্বাসকষ্টের সঙ্গে হাত বা পায়ের আঙুল নীল হয়ে গেলে।
অধ্যাপক ডা· তাহমীনা বেগম
বিভাগীয় প্রধান, শিশু বিভাগ
বারডেম ও ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ০৭, ২০০৮
Leave a Reply