২০০৮ সালে চিকিৎসাক্ষেত্রে উদ্ভাবন কম হয়নি। চমক এসেছে, আবার মিলিয়েও গেছে। কোনো কোনোটি ফেটেছে কম। গুরুত্বপূর্ণ অথচ সাধারণ অসুখ সম্পর্কে প্রচলিত জ্ঞানকে পাল্টেও দিয়েছে।
জীবন রক্ষার নায়ক হতে পারবেন
কাউকে দেখলেন ধপাস করে পড়ে গেছেন; বিশেষজ্ঞদের পরামর্শঃ পুরো সিপিআর ও রেসকিউ রিদম। তবে মার্চ মাসে আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন একটি ঘোষণা দিল, মুখ থেকে মুখে শ্বাস দেওয়ার প্রয়োজন নেই বড়দের জন্য। কারণ, তিনটি বড় গবেষণায় দেখা গেছে, কেবল বুক চেপে চেপে অনেক লোকের জীবন বাঁচানো গেছে। তাই কোনো বয়স্ক লোক ধপাস করে পড়ে গেলে ডাকুন কার্ডিয়াক অ্যাম্বুলেন্স, আর দুই হাত চেপে জোরে ও দ্রুত চাপুন বুকে। এতেই চলবে। প্রচলিত সিপিআর অচেতন লোক, শিশু বা ডুবে গেলে মাত্র কার্যকর।
নিয়ন্ত্রণ করা যাবে ক্ষুধা, হারানো যাবে দেহভার
একটি নতুন ধরনের খাদ্য আঁশ রেজিস্ট্যান্ট স্টার্চ আসছে, যা ওজন হ্রাস করার নতুন কৌশল। গত বছর একটি সুইডিশ স্টাডিতে দেখা গেছে, যারা রাতের খাবারে রেজিস্ট্যান্ট স্টার্চ (বার্লি রুটি) খেয়েছেন, এদের ক্ষুধা পেয়েছে অনেক কম; যারা সাদা রুটি খেয়েছেন, তাদের তুলনায় এতে ক্ষুধা নিবৃত্তি ঘটেছে পর দিন প্রাতরাশ খাওয়া পর্যন্ত। শিম, কাঁচকলা ও আলুতে (সাদা ও মিষ্টিআলু) রয়েছে এ ধরনের আঁশ। পরিপাক সহজে হয় না। শ্বেতসার যেহেতু রক্তস্রোতে সহজে ও দ্রুত প্রবেশ করে না, এটি রক্ত শর্করার মানকে সুস্থিত করে এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়। এটি স্বাস্থ্যহিতকর ব্যাকটেরিয়ার মান উজ্জীবিত করে, যা রোগ-প্রতিরোধব্যবস্থাকে লালন করে। তাই খাদ্যকে এসব পরিপাক-অনুপযোগী শ্বেতসারে ভর্তি করুন, এটিতে আরও আছে লাল ঢেঁকিছাঁটা চাল ও শস্যখাদ্য-বলেছেন আমেরিকান ডায়াবেটিক সমিতির লেসলি বন্সি।
এসব শ্বেতসার খাদ্যে যোগ করলে ক্ষুধা ও রক্তের চিনি দুটোর নিয়ন্ত্রণই কার্যকর হবে।
অস্টিওপরোসিসের চিকিৎসা উন্নত হলো
হাড়ের ক্ষয়ের জন্য নতুন ঝুঁকি গণক ফ্রেক্স থেকে আমরা জানতে পারি, আমাদের সত্যি সত্যি হাড় গঠনের জন্য ওষুধ প্রয়োজন হবে কি না। যেসব নারীর হাড়ের ঘনত্ব (বিএমডি) পরীক্ষা করে সীমা ছুঁই ছুঁই ফলাফল পাওয়া যায়, তাদের ওষুধ দেওয়া হবে কি না, এ নিয়ে চিকিৎসকদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। ফলাফল সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বলেন, অনেক নারী প্রয়োজন হওয়ার বেশ কয়েক বছর আগেই ওষুধ ব্যবহার শুরু করেন এবং পেটের গোলমাল থেকে শুরু করে খাদ্যনালির আলসারের মতো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ফ্রে নামে একটি নির্দেশিকা তৈরি করেছে, যাতে ১২টি উপাদানের কথা বলা হয়েছে, যেগুলো হাড়ের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে। যেমন ওজন, কোমর ভাঙার পারিবারিক ইতিহাস, কিছু ওষুধ ও অসুখ। ন্যাশনাল অস্টিওপরোসিস ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রস্তাবিত গাইড লাইন অনুযায়ী, হাড়ের ঘনত্বের পরীক্ষা যদি হাড়ের কঙ্কালের শক্তি সম্পর্কে উদ্বেগ সৃষ্টি করে, তবু ফ্রেক্স হাড়ের ভাঙনের ঝুঁকি ২০ শতাংশ ওপরে নির্দেশনা করলে ওষুধ ব্যবহার করা ঠিক নয়। তাই ফ্রেক্স স্কোর চেক না করে বিসফোসকোনেটস ওষুধ ব্যবহার করা ঠিক নয়। ৬৫ বছর বয়সে বিএমডি টেস্ট করা উচিত, এরপর ফ্রে স্কোর গণনা করে ফলাফল মূল্যায়ন করা উচিত।
রক্ষা পাবে ৪৭ হাজারটি জীবন প্রতিবছর
২০০৮ সালে তিনটি বড় গবেষণা ডায়াবেটিস চিকিৎসা করার বহুপ্রতীক্ষিত নির্দেশিকা দিয়েছে, যে রোগে প্রতিবছর দুই লাখ ৩৪ হাজার লোক মারা যায়। উত্তর হলোঃ এই রোগকে কঠোরভাবে ও আগেভাগে আঘাত করতে হবে এবং তৎক্ষণাৎ বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। এর একটি গবেষণায়, গবেষকেরা কেবল রক্ত গ্লুকোজের মানই নিয়ন্ত্রণ করেননি, তারা উচ্চমান কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইডও রক্তচাপ কমার ওষুধ ব্যবহার করেছেন। ফলে ১৩ বছরের মধ্যে এতে মৃত্যুর ঝুঁকি তারা কমিয়ে আনতে পেরেছেন ২০ শতাংশ। আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, মানবদেহে রয়েছে একটি জিনিস, যা গবেষকেরা বলেছেন ‘বিপাক-্নৃতি’। রোগ নির্ণয়ের পরপরই যাদের রক্ত গ্লুকোজ মান কমানো গেছে এদের মৃত্যুঝুঁকি কমে ১৩ শতাংশ।
তাই ডাক্তার যখনই বলবেন রক্তের গ্লুকোজের মান স্বাস্থ্যকর নয়, তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা গ্রহণে তৎপর হতে হবে। যাঁদের প্রাক-ডায়াবেটিস রয়েছে, তাঁদের জন্যও এটি প্রযোজ্য। কারণ, যতক্ষণ এই রোগে পূর্ণভাবে প্রকাশিত হয়ে আঘাত করবে, ততক্ষণে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে শরীরের-বলেছেন নিউইয়র্কের ডায়াবেটিস এডুকেশন সেন্টারে মেডিকেল ডিরেক্টর ডা· স্টুয়ার্ট উইস এমডি। গুরুত্বসহকারে অনুসরণ করতে হবে স্বাস্থ্যসম্মত আহার, ব্যায়াম, প্রয়োজনে ওষুধ, চিকিৎসকের আরও পরামর্শে ব্যক্তিবিশেষে কোলেস্টেরলের জন্য স্ট্যাটিনস ও উচ্চরক্তচাপের ওষুধ।
অপারেশন টেবিল থেকে দূরে থাকা যাবে
আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত হাঁটুর জন্য আর্থ্রোস্কোপিক সার্জারি তেমন প্রয়োজনীয় নয়, নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এ প্রকাশিত একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় তা বলা হয়েছে। ২০০ জন পূর্ণবয়স্ক লোক, যাদের মাঝারি থেকে গুরুতর অস্টিও-আর্থ্রাইটিস রয়েছে হাঁটুতে, এদের করা হয়েছিল আর্থ্রোস্কপি ও থেরাপি অথবা ফিজিক্যাল থেরাপি বা মেডিকেল থেরাপি-দুই বছর পর সার্জারি যাদের হয়েছিল, এরা তেমন উন্নততর অবস্থানে ছিল না। নিউইয়র্ক সিটিতে হাসপাতাল ফর স্পেশাল সার্জারিতে একজন হাঁটু ও কাঁধের সার্জন ডা· রবার্ট ম্যাক্স বলেন, কোমলাস্থি ছিন্ন হলে এর মেরামতিতে এবং অন্যান্য আঘাত মেরামতিতে আর্থ্রোস্কপি একটি কৌশল, তবে এটা ঠিক যে আর্থ্রোস্কপি করে আর্থাইটিস ভালো করা যায় না। ডাক্তারকে তাই হাঁটুর ব্যথা-বেদনার বিশদ বিবরণ দিতে হবে, কখন এটি শুরু হলো এবং ব্যথা কি ক্রমে ক্রমে এল, নাকি হঠাৎ এল (তীক্ষ্ন মোচড় খেয়ে ব্যথা হলে বোঝা যায় যে আহত হওয়ার জন্য ব্যথা হয়েছে)। প্রয়োজন হতে পারে এক্স-রে, এমআরআই ইমেজিং বা দুটোই। টেস্টে আর্থ্রাইটিস মনে হলে ফিজিক্যাল থেরাপি ভালো, ব্যথা কমার ওষুধ, প্রয়োজনে স্টেরয়েড ইনজেকশনস। ব্যথা যদি গুরুতর হয় এবং চিকিৎসায় কাজ না হয়, তখন পর্যায়ক্রমে হাঁটু প্রতিস্থাপন প্রয়োজন হতে পারে।
স্তন রক্ষায় নতুন অগ্রগতি
স্তন ক্যান্সারের প্রাথমিক স্তরে স্তনের গুটি অপসারণ করলে পাঁচ থেকে সাত সপ্তাহের দৈনিক বিকিরণ চিকিৎসার মুখোমুখি হতে হয়-যাঁরা কর্মজীবী, যাঁদের ছোট বাচ্চা আছে, যাঁরা ক্লিনিক থেকে অনেক দূরে থাকেন, তাঁদের জন্য এত কষ্টকর যে অনেক সময় পুরো স্তন অপসারণে রাজি হতে চান। ১২ বছর কানাডার একটি গবেষণার ফলাফল থেকে জানা যায়, সামান্য বেশি দৈনিক বিকিরণ প্রয়োগে একই রকম কার্যকারিতা পাওয়া যায় তিন সপ্তাহে। তাই ম্যামোগ্রাম সময়মতো করানো জরুরি-ক্যান্সার আগাম শনাক্ত হলেই এর চিকিৎসা সম্ভব।
কমিয়ে ফেলুন ডায়াবেটিসের ঝুঁকি
গবেষকেরা অনেক দিন ধরেই ধারণা করছেন যে দেহের বিএমআই যদি ২৫-এর নিচে হয় (১৪৫ পাউন্ডের নিচে ওজন, উচ্চতা পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি হয়), তাহলে স্থূলতার বিরূপ প্রভাব থেকে নিরাপদ। তবে মেয়োক্লিনিকের একটি গবেষণা থেকে জানা যায়, অনেক নারীই বিপজ্জনকভাবে স্কিনি ফ্যাট (দেখতে শুকনো অথচ মেদবহুল!)। এক হাজার ১০১ জন নারীর অর্ধেকের বেশি, যাদের বিএমআই ২৫-এর কম, তাদের দেহের চর্বি ৩০ শতাংশের বেশি, এদের বলে ‘স্বাভাবিক ওজনবিশিষ্ট স্থূল’ নারী। যেহেতু চর্বি কোষসমূহ বিপজ্জনক হরমোন নিঃসরণ করে, এ জন্য এ ধরনের নারীদের প্রি-ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা যাদের দেহে চর্বি কম, এদের তুলনায় চার গুণ বেশি।
দেখতে ক্ষীণদেহী হলেও দেহে চর্বি থাকতে পারে লুকিয়ে, আয়নায় নিজের চেহারা দেখে মেদবহুল কি না, বোঝা যায় না অনেক সময়। বাড়তি চর্বিকোষ লুকিয়ে থাকতে পারে পেটের ভেতর গভীরে, বাহু ও পায়ে ছড়িয়ে থাকতে পারে সমভাবে। তাই দেহের চর্বির শতকরা পরিমাপ করা প্রয়োজন। এটি মাপার যন্ত্র আছে। ৩০ শতাংশের বেশি চর্বি থাকলে কেবল ক্যালোরি কম খেলে হবে না, এতে চর্বির সঙ্গে লিনটিসুও ক্ষয়ে যাবে; বরং যোগ করুন ব্যায়াম। কার্ডিও ও স্ট্রেংথ ট্রেনিং একত্রে করুন, চর্বি পুড়বে, পেশি গঠিত হবে।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস
বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ০৭, ২০০৮
Leave a Reply