দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য নতুন উদ্যোগ
মোর্শেদার একটি চোখ তুলে ফেলা ছাড়া চিকিৎসকদের আর কিছু করার নেই। মুখের সৌন্দর্য ঠিক রাখার জন্য আরেকটি কৃত্রিম চোখ বসানো যেতে পারে। তবে চিকিৎসকদের মতে, ১৪ বছর বয়সী মোর্শেদার পরিবার সচেতন হলে ও সঠিক পদক্ষেপ নিলে হয়তো তার কপালে এ দুর্ভোগ নেমে আসত না। অন্তত চিকিৎসার উদ্যোগ নেওয়া যেত।
দরিদ্র রোগীদের জন্য আয়োজিত একটি চক্ষুশিবিরে কথা হয় পোশাকশিল্পের শ্রমিক মোর্শেদার সঙ্গে। মায়ের সঙ্গে একবুক আশা নিয়ে শিবিরে এসেছিল। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের ‘এ নিউ ভিশন-ঢাকা আরবান কম্প্রেহেনসিভ আই কেয়ার’ প্রকল্পের আওতায় সাইটসেভারস ইন্টারন্যাশনাল এ শিবিরের আয়োজন করে। প্রকল্পটির সার্বিক তত্ত্বাবধান করবে এ সংস্থা।
পল্লবী ২ নম্বর ওয়ার্ড কমিউনিটি সেন্টারে অনুষ্ঠিত শিবিরে অপেক্ষমাণ অবস্থায় মোর্শেদার সুন্দর ফুটফুটে মুখে এবং একটি চোখে তখনো চোখ ভালো হওয়ার কিঞ্চিৎ আশা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল। কিন্তু চিকিৎসকের প্রাথমিক বক্তব্যে মা ও মেয়ে অনেকটাই মুষড়ে পড়েন। চক্ষুশিবিরে প্রাথমিকভাবে চোখ পরীক্ষার পর বাংলাদেশ জাতীয় অন্ধকল্যাণ সমিতি পরিচালিত মিরপুরের ঢাকা চক্ষু হাসপাতালে পাঠানো হয় মোর্শেদাকে। চক্ষু হাসপাতালে মোর্শেদার মা হাজেরা বেগম জানান, মোর্শেদার এক বছর বয়সের সময় ডায়রিয়া হয়। কোনোমতে বেঁচে যায় সে। তবে তার দুই চোখে মাছের আঁশের মতো দাগ পড়ে। পরে এক চোখ ভালো হলেও আরেক চোখে দাগ স্থায়ী হয়ে যায়।
তিনি বলেন, ‘মাইয়ার চোখ ভালা করার জন্য সরকারি ডাক্তার দেখাইছি। পরে কবিরাজরে দেখাই। কবিরাজ চোখে দেওনের ওষুধ দেয়। এর পরও ভালা না অইলে মাসখানেক মাইয়ারে ম্যালা জায়গায় নিয়া যাই। যে যেখানে কইছে সেইখানেই দৌড়াইছি।’ হাজেরা বেগমকে গ্রামের চিকিৎসক বলেছিলেন, আগে চিকিৎসকের কাছে নেওয়ার দরকার নেই, মেয়ের বয়স ২০ বছর পার হলে তখন চিকিৎসকের কাছে নেবেন। চিকিৎসকের মন্তব্যের কারণে, অভাব আর সুযোগ না ঘটায় মোর্শেদার পরিবারও অনেকটা নিশ্চুপ হয়েই ছিলেন এতগুলো বছর। স্বল্পমূল্যে চক্ষুচিকিৎসার সুযোগের কথা মাইকে শুনে মা ও মেয়ে এবার উদ্যোগী হয়েছেন।
মোর্শেদার জীবনের ইতিহাস শুনে এবং বিভিন্ন যন্ত্রের মাধ্যমে চোখ পরীক্ষা করে ঢাকা চক্ষু হাসপাতালের চক্ষুবিশেষজ্ঞ ডা· মোহাম্মদ আলী আহসান জানান, অপচিকিৎসা ও অনেক দেরি করে ফেলায় মোর্শেদার একটি চোখ আর কখনো ভালো হবে না। ভয়াবহ ডায়রিয়ায় মোর্শেদার চোখের কর্নিয়া ঘোলা হয়ে গেছে। বর্তমানে এমন পর্যায়ে এসেছে যে কর্নিয়া সংযোজনের উপায়ও নেই। যদি সামর্থ্য থাকে তাহলে চোখ তুলে ফেলে কৃত্রিম একটি চোখ লাগিয়ে দেওয়া যাবে।
এ সময় মোর্শেদা এক চোখ দিয়ে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। তার মা অনেকটা নির্বাক হয়ে যান। কেননা যেখানে দিন আনতে পান্তা ফুরায় সেখানে মেয়ের মুখের সৌন্দর্য ঠিক রাখার জন্য কৃত্রিম চোখ বসানোর ক্ষমতা তাঁর নেই।
অভাবের তাড়নায় গ্রাম ছেড়ে হাজেরা বেগম স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় এসেছেন তিন মাস আগে। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন ছয় মেয়ে ও এক ছেলেকে। স্বামী ছোটখাটো কাজ করেন। মোর্শেদাকে একটি পোশাকশিল্প কারখানায় কাজ করতে হচ্ছে।
এ রকম দরিদ্রদের কথা চিন্তা করেই ঢাকার সুবিধাবঞ্চিত দুই লাখ ৭০ হাজারেরও বেশি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষকে সহায়তা দেওয়ার জন্য শুরু হয়েছে ‘ঢাকা আরবান কম্প্রিহেনসিভ আই কেয়ার’ প্রকল্প। চিকিৎসাযোগ্য অবস্থায় থাকলে যেকোনো রোগীর চোখের যাবতীয় খরচ এ প্রকল্প বহন করবে বলে জানালেন প্রকল্পের কর্তাব্যক্তিরা। তবে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা যাতে সময় থাকতেই সচেতন হয়ে চিকিৎসা নিতে পারে, সে জন্যই এ আয়োজন বলে জানালেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা।
সাইটসেভার্স ইন্টারন্যাশনালের এ-দেশীয় পরিচালক ড· ওয়াহিদুল ইসলাম জানান, প্রকল্পটি পাঁচ বছর চলবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে সহযোগিতা করবে ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতাল, বাংলাদেশ জাতীয় অন্ধকল্যাণ সমিতি, আদ্-দ্বীন হাসপাতাল ও সালাউদ্দিন বিশেষায়িত হাসপাতাল। প্রকল্পের আওতায় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের খুঁজে বের করা হবে, তাদের চোখের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা করবে। এ ছাড়া চোখের যত্ন ও সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করবে।
উল্লেখ্য, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ঢাকাসহ বিশ্বের ২০টি শহরের সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে সাহায্যের লক্ষ্যে প্রায় ১৪০ কোটি টাকা সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত ও আফ্রিকায় কার্যক্রমটি শুরু হয়েছে।
মানসুরা হোসাইন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ০৭, ২০০৮
Leave a Reply