শীতের সন্ধ্যায় ঝলসানো খাবারে আড্ডাটা দারুণ জমে নেহাত খাওয়াদাওয়া নয়, এর বাইরেও অনেকখানি। এ খাবারের মূল তৃপ্তি—উপলক্ষে, আয়োজনে। এই শীতে বান্দরবানের কোনো এক ছোট্ট পাহাড়ে তাঁবু টানিয়েছেন তাঁরা কয়জন, রাতে তাঁবুর সামনে আগুন তো পোহাতেই হবে। আর সেই আগুনের উষ্ণ স্বাদ নাকেও লাগা চাই। ক্যাম্প ফায়ারে অন্তত একটা মুরগি না ঝলসালে তাঁবুবাসটাই জমে না যেন। শুধু বনেবাদাড়েই নয়, বার-বি-কিউয়ের এমন আয়োজন এখন অনেক ঘরোয়া আড্ডার উপলক্ষ বনে গেছে। খাবারের বাইরেও আড্ডা জমাতে আলাদা একটা আবেদন আছে বার-বি-কিউয়ের। ‘সন্ধায় চলে আসিস। আজ বার বি কিউ হবে।’ খুদে বার্তা, কিংবা ফোন; বন্ধুর ডাকে এ কথাই যথেষ্ট। বার বি কিউ আড্ডার ডাক ফেরানো যায় না।
আয়োজনটাই আসল
ঘরের খাবারে শুধু রান্নার একটা পদ বাড়াতে ঝলসানো খাবারের ঝক্কিতে কেউ যায় না সাধারণত। এমন হতে পারে শুধুই পরিবারের সবার জন্য এটি করা হবে। তাহলে ওই আয়োজনটাও আর খুব সাধারণ থাকবে না। বার-বি-কিউ ওই মামুলি ঘরোয়া আয়োজনে অন্য আমেজ এনে দেবে। আর যা-ই হোক, শুধু নিজের জন্য বার-বি-কিউ করে পোষাবে না, ঝক্কির সঙ্গে মিলবে না তৃপ্তির হিসাব। বার-বি-কিউয়ের আসল স্বাদ পেতে আপনাকে কয়জন বন্ধু ডাকতেই হবে, পরিবারের সবাইও থাকতে পারে। তবে বার-বি-কিউ রান্নায় যত মজাই হোক, তৈরি করা খাবার থালায় সুন্দর পরিবেশনাই যথেষ্ট নয় এখানে। বরং পুরো আয়োজনটাই তৃপ্তির অনুষঙ্গ এখানে। রান্নাটা কোথায় হচ্ছে, আড্ডা জমছে কি না, পরিবেশনায় আর কী থাকছে—এ সবকিছুই আসবে তৃপ্তির প্রশ্নে।
আড্ডা জমবেই
কোথায় হবে বার-বি-কিউয়ের আয়োজন? রান্নাঘরে? নাহ্, জমবে না। রান্নার আয়োজনটা এমন জায়গায় করতে হবে, যেখানে আড্ডা জমানো যায়। হতে পারে বাসার ছাদে। আর বাসায় একটা সবুজ চত্বর থাকলে তো কথাই নেই। আসর বসাতে হবে খোলা জায়গায়। ভালো হয় সবাই বার-বি-কিউয়ের আগুন ঘিরে বসলে। এ আয়োজনকে বাড়ির বাইরে নিতে চাইলে বেছে নিন খোলা কোনো জায়গা। নিঝুম বন, সমুদ্রসৈকত কিংবা পাহাড়ের ঢাল বা টিলার চূড়া হলে তো কথাই নেই, একটা খোলা মাঠ হলেও বার-বি-কিউ আড্ডা জমে উঠবে ভিন্ন আমেজে। তবে একটা কথা ভাবতে পারলে ভালো হয়, ঘরের বাইরে এমন জম্পেশ আড্ডা মানেই গলা ছেড়ে চিল্লাপাল্লা। তাই জায়গা নির্বাচনের আগে এ বিষয়টাও ভেবে নেওয়া ভালো, যাতে আপনার আড্ডা আবার কারও অসুবিধার কারণ না হয়ে যায়। এখন অবশ্য পার্টি, বড় অনুষ্ঠান কিংবা অনেক রেস্তোরাঁয়ও বার-বি-কিউ কর্নার থাকে। এমনকি বার-বি-কিউয়ের জন্য বিশেষায়িত রেস্তোরাঁও গড়ে উঠেছে ঢাকায়। তবে নিজেরা বার-বি-কিউ করার আমেজটা একেবারেই অন্য রকম। আর সময়? বার-বি-কিউয়ের চুলা বছরের যেকোনো সময় জ্বালানো যেতে পারলেও আগুন পোহানোর ব্যাপার না থাকলে বাব-বি-কিউ আড্ডা যেন অপূর্ণ থেকে যায় খানিকটা। এই আসর শীতেই জমে বেশি।
হোক না কাঁচা হাত
বার-বি-কিউ আড্ডা জমাতে হলে এই রান্নায় পূর্বাভিজ্ঞতা থাকতে হবে, এমন কথা নেই। বন্ধুরা সবাই মিলে রান্না করায় যে মজা মিলবে, রান্নার হাত সেখানে থোড়াই পাত্তা পাবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সালাম-বরকত হলের আবাসিক শিক্ষার্থী শেখ আজম আলী। এখন তো হল জীবন, এর আগেও রান্না করা তো দূরের কথা, জীবনে চুলার পথ মাড়াননি তিনি। গত মাসে বন্ধুরা মিলে ঠিক করলেন, আজ বার-বি-কিউ হবে। হলের কাছেই গেরুয়ার খোলা জায়গা। সেখানে মাটি খুঁড়ে চুলা করা হলো। হল থেকে কাঠ এনে করা হলো জ্বালানির জোগাড়। দুইটি মুরগি আর হলের ডাইনিং থেকে চেয়ে আনা মসলা। ব্যস, মধ্য রাত পর্যন্ত চেষ্টা-তদবির আর সবার পাচকীয় পণ্ডিতি। শেষমেশ তথাকথিত যে বার-বি-কিউটা তারা খেল, এর অমৃত স্বাদ নাকি সবার জিভে লেগে থাকবে আজীবন। আজম বলেন, এমন আয়োজনে স্বাদটা আসলে রান্নার ওপর নির্ভর করে না। মূল তৃপ্তি আসে পারিপার্শ্বিকতা থেকে, বন্ধুদের নির্মল আড্ডায়। একই অবস্থা সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোনো একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের বিপণন বিভাগে কর্মরত সামিয়া আনসারিরও। তারা বার-বি-কিউ আড্ডা জমিয়েছিল বাসার ছাদে। এখানকার আয়োজন অবশ্য বেশ পরিপাটি ছিল; বার-বি-কিউয়ের বিশেষ চুলা, কাঠকয়লা, সযতনে মেপে মেপে কাটা গরুর মাংস, ইন্টারনেট থেকে পাওয়া কয়েকটা রেসিপি, হরেক রকম মসলা আর যাবতীয় অনুষঙ্গ, সবই ছিল। কিন্তু আজমের সুরেই কথা বললেন সামিয়া; পুরো আয়োজনের সবচেয়ে ভালো অংশ ছিল অনেক দিন পর দেখা হওয়া বন্ধুদের সঙ্গে নির্মল আড্ডাটা।
পাকা হাতের রেসিপি
বার-বি-কিউ আড্ডার জন্য পাকা হাতের রেসিপি দিয়েছেন রান্না বিশেষজ্ঞ সিতারা ফিরদৌস। তিনি জানান, মাছ-মাংস দুটোরই বার-বি-কিউ হতে পারে। মাছের ক্ষেত্রে সামুদ্রিক মাছ যেমন কোরাল কিংবা ভেটকি হলে ভালো হয়, এগুলোতে কাঁটা কম থাকে বলে। গরু বা খাসির মাংসু আকার ঠিক রেখে কাটতে হবে। দুই ইঞ্চি দৈর্ঘ্য ও দুই ইঞ্চি প্রস্থে তুলনামূলক পাতলা করতে হবে মাংসের টুকরো। মাংসের টুকরোগুলো একটু থেঁতো করে নিতে হবে। মাংস থেঁতলানোর জন্য বিশেষ হাতুড়ি পাওয়া যায়। শিল-পাটায়ও কাজ চালিয়ে নেওয়া যায়। মুরগি হতে হবে চামড়াসহ। বার-বি-কিউয়ের স্বাদের অনেকটাই নির্ভর করে ম্যারিনেটের ওপর। গরুর মাংসের বেলায় সব মসলা মাখিয়ে টুকরোগুলো রেখে দিতে হবে অন্তত ঘণ্টা চারেক। মুরগির বেলায় অবশ্য এক-দেড় ঘণ্টার ম্যারিনেটই যথেষ্ট। মুরগি কাটতে হবে চুলার আকারের কথা মাথায় রেখে। আস্ত মুরগিটাই যেমন বার-বি-কিউ করা যায়, তেমনি এটিকে দুই বা চার টুকরো করে নেওয়া যেতে পারে। সাধারণ মসলার সঙ্গে আদা বাটা, রসুন বাটা, টমেটো সস, টক দই, লবণ ও লেবুর রস দিয়ে ভালো করে মাংস মাখাতে হবে। এর সঙ্গে ঘি বা তন্দুরি মসলা দিলে ঘ্রাণটা ভালো হয়। এরপর ম্যারিনেটেড মাংস লোহার শিকে বিঁধিয়ে বা চুলার ওপর শিকের জ্বালে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুড়তে হবে। মাঝেমধ্যে একটু একটু মসলা ব্রাশে করে দিতে হবে। মাছের বেলায়ও রেসিপিটা অনেকটা একই রকম। এ তো গেল আমাদের দেশি স্বাদের বার-বি-কিউয়ের কথা। এর পাশাপাশি ভিনদেশি স্বাদের বার-বি-কিউয়ের কথা বলেছেন প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলের এক্সিকিউটিভ যোশেফ ডমিনিক গোমেজ। ইউরোপীয় রেসিপির বার-বি-কিউয়ে মসলার ঝক্কি অনেক কম। এখানে মাংসের সঙ্গে সল্ট পেপার, ব্ল্যাক পেপার আর সস দিয়ে মাখিয়েই মেরিনেট করা যায়।
বার-বি-কিউয়ের তৃপ্তি অনেকটা নির্ভর করে এর পরিবেশনায়। ঘরের বাইরে আয়োজন করলে কলাপাতা বা অন্য গাছের পাতায় তা পরিবেশন করা যেতে পারে। সঙ্গে অবশ্যই সবজি, সালাদ থাকতে হবে। খাওয়া যেতে পারে রুটি, পরোটা, তন্দুর রুটি কিংবা ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের সঙ্গে।
তো হয়ে যাক…
বন্ধুদের নিয়ে আজই হয়ে যেতে পারে বার-বি-কিউ আড্ডার ভিন্ন আয়োজন। মূল ঝামেলা চুলা নিয়ে। বার-বি-কিউয়ের বিশেষ চুলা পাওয়া যায় কারওয়ান বাজারসহ বিভিন্ন জায়গায় গ্যাসের চুলা বিক্রেতাদের দোকানে। মোটামুটি ভালো মানের একটি চুলার দাম পড়বে দেড় থেকে আড়াই হাজার টাকা। চুলা না পাওয়া গেলে এক ফুট প্রস্থ ও তিন ফুট দৈর্ঘ্যের সমান জায়গায় ইট বিছিয়ে এর পাশে আর কয়েকটি ইট খাড়া করে, ইট বিছানো জায়গাটা আবদ্ধ করে, তার ওপর কয়েকটা লোহার শিক দিয়েও বার-বি-কিউ চুলা তৈরি করা যেতে পারে। ডমিনিক গোমেজ বলেন, কয়লার চুলায় বার-বি-কিউ করা সবচেয়ে ভালো। তবে গ্যাস, এমনকি কাঠের আগুনেও বার-বি-কিউ করা যেতে পারে। কয়লার চুলায় খেয়াল রাখতে হবে, কয়লার আগুন যখন জ্বলতে থাকবে, তখন মাংস চড়ানো যাবে না, একটু পর কালি ছাড়া জ্বলজ্বলে কয়লার ওপর মাংস পোড়াতে হবে। কালির ব্যাপারটা খেয়াল করতে হবে সব চুলায়ই। চুলার কয়লার জন্য বিশেষ দোকান আছে, তা না হলে আশপাশের কোনো কাবাবের দোকান, গাড়ির ব্যাটারি মেরামতের দোকান, এমনকি চায়ের দোকান থেকেও কাঠকয়লা সংগ্রহ করা যাবে। নিউমার্কেটে কিনতে পাওয়া যাবে কয়লা।
সাবধান!
আড্ডায় আবার সাবধানতা কী! তবে অবশ্যই সাবধান থাকতে হবে আগুন নিয়ে। আগুন তো আর বন্ধুতার মেজাজ বোঝে না। খুব বাতাসে চুলা জ্বালানো যাবে না। যেখানে চুলা থাকবে, তার আশপাশে যেন খড়কুটো বা অন্য কোনো দাহ্য পদার্থ না থাকে। বার-বি-কিউ করা শেষ হলে পোড়া কয়লায় বেশি করে পানি দিয়ে চুলা নিভিয়ে দিতে হবে অবশ্যই। মনে রাখতে হবে, জ্বলজ্বলে কয়লার টুকরো বাতাসে ছিটকে গিয়ে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে।
জাবেদ সুলতান
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ২৬, ২০১০
Leave a Reply