বছর তিরিশেই হাত কাপছে বহুজাতিক সংস্থার সেলস ম্যানেজার সাধন সাতরার। কখনও শারীরিক দুর্বলতা ছিল না। হঠাৎ হাত কাপতে শুরু করায় পরিবার হতবাক। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখানো হল। কোনও রোগ নয়। অফিসের টেনশন কাটাতে তিনি চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই পাড়ার ওষুধের দোকান থেকে টপাটপ রক্তচাপ কমানোর একটি ওষুধ কিনে খেতেন। তার পাশ্বর্ প্রতিক্রিয়াতেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন অজয়নগরের ওই যুবক। এতটাই যে, শয্যা নিয়েছেন।
ভবানীপুরের সুকন্যা চৌধুরী পেটে রক্তক্ষরণের সমস্যা নিয়ে ভর্তি হন এসএসকেএম হাসপাতালে। অতিরিক্ত ক্ষরণে রক্তচাপ নামছিল হুহু করে। ডাক্তারেরা রক্তপাতের কোনও আপাত কারণ খুজে পাচ্ছিলেন না। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জেনেছেন, মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হওয়ায় ওই মহিলা ব্যথা কমানোর ওষুধ খেতেন। ওষুধের লাগামছাড়া ব্যবহার তার অন্ত্র ফুটো করে দিয়েছে। মাস দুয়েক হাসপাতালে কাটিয়ে ঘরে ফেরেন ওই মহিলা।
মাঝেমধ্যে অসহ্য পেটব্যথা হত বারাসতের বিমল করের। জ্বর-জ্বর ভাব। দোকান থেকে প্যারাসিটামল ও ব্যথা উপশমের ওষুধ কিনে খেতেন তিনি। ব্যথা সেরে যেত। জ্বরও বাড়ত না। এক রাতে অত্যধিক পেটব্যথা আর চেপে রাখতে পারেননি বছর চিল্লশের ওই সরকারি কর্মী। তাকে ভর্তি করানো হয় স্থানীয় হাসপাতালে। পরের দিন মারা যান তিনি। সংক্রমণে তার অ্যাপেণ্ডিসাইটিস ফেটে গিয়েছিল। চিকিৎসকেরা জানান, মাঝেমধ্যেই বিমলবাবুর পেটব্যথার কারণ ছিল ওই অ্যাপেণ্ডিসাইটিসের সংক্রমণ।
নিজেই নিজের চিকিৎসা করলে ফল কি মারাত্মক হতে পারে, উপরের তিনটি ঘটনা তার প্রমাণ। একেবারে শেষ মুহূর্ত ছাড়া ওই তিন জনের কেউই কখনও চিকিৎসকের কাছে যাননি। দোকান থেকে ওষুধ কিনে খেয়েছেন। বিনা প্রেসক্রিপশনে দোকান থেকে ওষুধও পেয়ে গিয়েছেন ওঁরা।
এসব ঘটনার উদাহরণ দিয়েই জেলায় জেলায় তারই প্রচার চালাচ্ছে ইণ্ডিয়ান ফার্মাকোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশন। এই বিপজ্জনক প্রবণতার জন্য এক দিকে যেমন ভুক্তভোগীদের দায়ী করা হয়েছে, তেমনই দায়ী করা হয়েছে ওষুধের দোকানের কর্মীদের একাংশকেও। অ্যাসোসিয়েশনের মতে, ওষুধের দোকানগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফার্মাসিস্ট রাখে না। তাই গুণাগুণ বিচার না-করে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই ক্রেতাকে ওষুধ দেওয়া হচ্ছে।
রাজ্য জুড়ে সমীক্ষা চালিয়ে ওই অ্যাসোসিয়েশন দেখেছে, ‘সেল্ফ মেডিকেশন’-এর বিপজ্জনক প্রবণতা দিনকে দিন বাড়ছে। অম্বল, জ্বর, পেটব্যথা, সর্দি-জ্বর হলেই এক শ্রেণির মানুষ চলে যাচ্ছেন ওষুধের দোকানে। হয় নিজেরা ওষুধের নাম বলছেন বা দোকানকমর্রী পরামর্শে ওষুধ কিনছেন। সংগঠনের সভাপতি দীপঙ্কর চক্রবর্তী বলেন, ‘‘সাধারণ মানুষ ও ওষুধের দোকানের কর্মীদের এই বিপজ্জনক প্রবণতা থেকে মুক্ত করার জন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সেল্ফ মেডিকেশন এক শ্রেণির মানুষকে নিঃশেব্দ মৃত্যুর পথে নিয়ে যাচ্ছে। এটা এখন সামাজিক ব্যাধির চেহারা নিয়েছে।’’
গ্যাস্ট্রো-এন্টোরোলজিস্ট অভিজিৎ চৌধুরীর আক্ষেপ, ‘‘একমাত্র আমাদের দেশেই বোধ হয় প্রেসক্রিপশন ছাড়াই ওষুধ বিক্রি হয়। মুদির দোকানের সঙ্গে ওষুধের দোকানের কোনও পার্থক্যই নেই! এ ব্যাপারে সব থেকে এগিয়ে আছে পিশ্চমবঙ্গ। লিভারের অসুখে ভোগেন, এমন অনেকের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, সেল্ফ মেডিকেশনের ‘সংস্কৃতি’ই এর মূলে। আমাদের দুর্ভাগ্য, এই সংস্কৃতি বাঙালি জীবনের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে।’’ ফার্মাকোলজিস্ট সমিতির মতো অভিজিৎবাবুরও দাবি, প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ বিক্রি বন্ধ হোক। নইলে এই ব্যাধি দূর হবে না।
এ ব্যাপারে যাদের দায়িত্ব নেওয়ার কথা, সেই ড্রাগ কেন্ট্রালের এক কর্তা জানান, তারা ফার্মাকোলজিস্ট সমিতি, ইণ্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে কথা বলে পরিকল্পনা তৈরি করবেন ও দেশ জুড়ে প্রচার চালাবেন।
সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৩ ডিসেম্বর ২০০৮
শুভাশিস ঘটক, কলকাতা
Leave a Reply