সমস্যা: বাবাকে হারিয়েছি সাত বছর বয়সে। তারপর থেকে ফুপুর বাসায় আছি। এখানে থেকেই অনেক বাধ্যবাধকতার মধ্যে এ বছর এইচএসসি পাস করেছি। এখানে থাকতে আমার প্রচুর সমস্যা হয়। মানসিক, শারীরিক, পারিপার্শ্বিক কোনো ধরনের প্রশান্তি আমি এখানে পাই না। অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে এক বার বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর মা অনেক বুঝিয়ে আবার এখানে (ফুপুর বাসায়) দিয়ে গেছেন। মা কিছু একটা করার জন্য চাপ দিচ্ছেন। তিন বোনকে নিয়ে তিনিও আর সংসার চালাতে পারছেন না। আমার অমতেই একজনকে বাল্যবিয়ে দিয়েছেন। আমি পড়াশোনাটা চালিয়ে নিতে চাই। এখানে (ফুপুর বাসায়) থেকে তা সম্ভব নয়। চাকরির অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু হয়নি বা প্রতারিত হয়েছি। আমাদের সম্পদ বলতে কিছুই নেই।
তুহিন, সিলেট।
পরামর্শ: বুঝতে পারছি বাবার মৃত্যুর কারণে তোমাকে খুব ছোটবেলায়ই বৈরী পরিবেশে অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করতে হয়েছে। হঠাত্ করে বাবা মারা যাওয়ায় মা-ও খুব বিপদে পড়েছেন, তাতে সন্দেহ নেই। একটি পরিবারের আয়-ব্যয়ের হিসাব অনুযায়ী যদি পরিবারে নতুন সদস্যের আগমনটি সুপরিকল্পিতভাবে না করা হয়, তাহলে সন্তানদের ওপর এর খুব বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তোমার অসহায় বোনেরাও কোনো দোষ না করে প্রতি মুহূর্তে চরম মূল্য দিচ্ছে। অভিভাবকদের তাই এসব ব্যাপারে দূরদর্শিতা রেখে চলা প্রয়োজন। আমরা সবাই যেকোন সময়ে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারি— এ কথাটি মাথায় রেখে কিছু অর্থ সঞ্চয় করে রাখাটা খুব জরুরি। বাংলাদেশের স্বল্প এবং মধ্য আয়ের মানুষের মধ্যে আমি ভবিষ্যত্ পরিকল্পনার বেশ অভাব লক্ষ্য করি। যদিও শুনলে খুব নিষ্ঠুর মনে হবে, তারপরও বলব, যাঁদের আর্থিক সংকট রয়েছে তাঁরা নিজেদের স্বার্থে অনেক শিশুর জন্ম দিয়ে কিন্তু তাদের বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন। এতে করে শিশুদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। তুমি যেহেতু অনেক ঝড়ঝঞ্ঝা মাথায় নিয়ে শিশুবয়স থেকে এতটা পথ পাড়ি দিয়েছ, বাকিটুকুও কষ্ট করে পাড়ি দেওয়ার সংকল্প নাও। নিজেকে সারাক্ষণ অভিনন্দন জানাবে এবং অনেক শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখবে এই কারণে, তুমি এখনো হাল ছেড়ে দাওনি। কখনো নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়ো না এবং সৃষ্টিকর্তার ওপর আস্থা রেখে চল। চারদিকের চাপে যখন আমাদের সামনের পথ হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়, তখন আমরা একমাত্র সৃষ্টিকর্তার কাছেই সাহায্য চাইতে পারি। তোমাকে নিয়ে মায়ের উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং প্রত্যাশা থাকাটা স্বাভাবিক, তবে বাস্তবতা মাথায় রেখে এখন থেকে তুমি তোমার কিছু লক্ষ্য স্থির কর যাতে করে তোমার কাজ করা বা পড়াশোনা করার স্পৃহা বজায় থাকে। অনেক অনেক শুভকামনা রইল তোমার জন্য।
সমস্যা: আমার বিবাহিত জীবন পাঁচ বছরের। আমার স্বামী শুধু আমাকে সন্দেহ করেন। আমি যাঁদের শ্রদ্ধার চোখে দেখি তাঁদের নিয়েও। আমি নাকি তাঁদের পছন্দ করি, তাঁদের সঙ্গে প্রেম করব। কিন্তু আমি তা স্বপ্নেও ভাবি না। আমি মোবাইল ফোন ব্যবহার করি, এতে আমার স্বামী মনে করেন, আমি ফোনেও কোনো ছেলের সঙ্গে প্রেম করি, কথা বলি।
এই সন্দেহ নিয়ে আমার স্বামীর সঙ্গে প্রায় ঝগড়া ও কথাকাটাকাটি হয়। আমি তাঁকে অনেকভাবে বোঝাই, আমি কোনো কিছু করি না। আমি শুধু তাঁকেই ভালোবাসি। এ অবস্থায় কারও সঙ্গে ভালোভাবে মিশতে বা কথা বলতে আমার ভয় হয়। কিন্তু এভাবে থাকতে আমার ভালো লাগে না। আমি মানসিকভাবে সমস্যায় আছি। আমার এভাবে বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
পরামর্শ: একটি সম্পর্কের ক্ষেত্রে যখন বিশ্বাসের অভাব হয়, তখন সবচেয়ে বেশি তিক্ততার সৃষ্টি হয়। আমি বুঝতে পারছি তুমি কতটা মানসিক বিপর্যস্ততার ভেতর দিয়ে যাও, যখন কোনো ভিত্তি ছাড়াই তোমার স্বামী আশপাশের সম্মানিত ব্যক্তিদের নিয়ে তোমাকে সন্দেহ করেন। স্বামীকে তুমি বোঝানোর পর সে কিছুটা বুঝেও আবার যখন আগের সন্দেহের জায়গাটায় ফিরে যাচ্ছেন, তখন তোমার মধ্যে প্রচণ্ড হতাশা তৈরি হওয়ারই কথা। স্বামী যদিও অন্য কোনো খারাপ আচরণ করছেন না, তারপরও এই বিষয়টিকে মেনে নেওয়া অত্যন্ত কঠিন। যেহেতু তুমি লিখেছো এই সন্দেহের কোনো ভিত্তি নেই, মনে হচ্ছে তোমার স্বামী প্যারানয়েড ডিসঅর্ডারে ভুগছেন। এ ধরনের মানসিক অসুস্থতায় জীবনসঙ্গীর আনুগত্য নিয়ে মনে খুব সন্দেহ কাজ করে। তোমার হয়তো মনে হচ্ছে তিনি তোমাকে খুব বেশি ভালোবাসেন বলেই এমন করছেন। তবে ভালোবাসার প্রকৃত অর্থ কিন্তু অন্য মানুষটিকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে, তাঁর মতামতকে শ্রদ্ধা দেখিয়ে তাঁর সুস্থ এবং স্বাধীন ইচ্ছাগুলোকে মর্যাদা দেওয়া। তোমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সেটি ঘটছে না। যদি তোমার মনে হয়, স্বামী যতই সন্দেহ করুন না কেন তুমি এই সম্পর্কটি টিকিয়ে রাখতে চাও, তাহলে তাঁর ইচ্ছাকেই সব সময় প্রাধান্য দিয়ে জীবনে চলতে হবে। অর্থাত্ তোমার সামাজিক জীবনকে যতটা সম্ভব বাদ দিতে হবে। এ ছাড়া তো আর কোনো উপায় নেই। স্বামীর অহেতুক সন্দেহের কারণে কষ্ট হলেও তুমি ভাববে, এতে তুমি একটুও ছোট হওনি। এটি ওই মানুষটির সমস্যা এবং তোমার জীবনের অনেক অর্থ ও মূল্য রয়েছে। তা ছাড়া এর জন্য কিন্তু তোমার স্বামীকে খুব দোষারোপ করা যায় না, কারণ তিনি ইচ্ছা করে তাঁর ‘সন্দেহ’ তৈরি করছেন না। এই সন্দেহে ভোগা মানুষগুলো সাধারণত কোনো চিকিত্সা নিতে আগ্রহী হন না। তারপরও যদি সম্ভব হয়, তাহলে তোমরা দুজনে মিলেই কোনো ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের কাছে আগে যাও। তাঁরা কোথায় বসেন ঠিকানাগুলো আমি আগে দিয়েছি।
এরপর যদি মনোবিজ্ঞানী মনে করেন তোমার স্বামীকে কোনো ওষুধ দিয়ে চিকিত্সা করানো প্রয়োজন, তাহলে তাঁকে মনোচিকিত্সকের কাছে অবশ্যই নিয়ে যেতে হবে। নিয়মিত ওষুধ খাওয়া এবং সেই সঙ্গে থেরাপি গ্রহণ করার জন্য তাঁকে তাঁর পরিবারের মানুষদের দ্বারা বুঝিয়ে রাজি করাতে হবে।
অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম
কাউন্সেলিং সাইকোলজি
মনোবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ০৯, ২০১০
Leave a Reply