হাইলাইটস
- শোনা যায় সম্রাট আকবরের নির্দেশেই নাকি বাংলায় বেড়েছিল পোস্ত চাষ ।
- মুঘল খানায় রান্নায় স্বাদ বাড়াতে বা কোনও ঝোল ঘন করতে পোস্তর কদর ছিল বেশ।
- আলু পোস্ত, ঝিঙে পোস্ত, পেঁয়াজ পোস্ত, পোস্তর বড়া, পোস্ত বাটা সবই বাঙালি তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে।
- পোস্তর সঙ্গে আলুর মিশ্রণে বড়াও বেশ অন্যরকম।
বালির দানার মতো ছোটো ছোটো সাদা দানা। জলে ভিজিয়ে শিলে রেখে নোড়া দিয়ে গুনে গুনে চার বার ঘঁষলেই কেল্লাফতে। আজকাল অবশ্য মিক্সারে গ্রেড করে নেওয়া হয়। ডুমো করে আলু তেলে ভেজে তাতে মিশিয়ে দিন এই সাদা ঘন আধা তরল পদার্থটি। কিছুক্ষণ ঢাকনা চাপা দিয়ে রেখে দিন। ব্যস্, বিশ্বের অন্যতম সেরা পদটি তৈরি। নাম তার আলু পোস্ত। আরেকটু অন্য রকম করতে চাইলে আলুর সঙ্গে ঝিঙে দিয়ে দিন। স্বাদে বদল হবে।
ডায়াবিটিসে ভুগছেন? তাহলে আলুর বদলে বেগুন কিংবা ঢেঁড়শ ব্যবহার করুন। কোনও চাপ নেই।
মাছ, মাস, ডিমেও এটি দিয়ে কষাতে পারেন। স্বাদ হবে অনবদ্য। আরে বাবা দিনের শেষে ওটা যে পোস্ত। কাঁচা বেটে সর্ষে তেল, কাঁচা লঙ্কা, নুন আর কাঁচা পেঁয়াজ দিয়ে গরম ভাতে মেখে খান না। মনে হবে স্বর্গসুখে আপনি ডুবোডুবি খাচ্ছেন। চাইলে পোস্তর বড়া করে খান। আরও ভালো লাগবে।
যত পাই তত খাই
বাঙালির প্রিয় পোস্ত। ঘটি-বাঙাল নির্বিশেষে সকলের প্রিয় খাবার। পুরোনো প্রজন্ম হোক বা নতুন পোস্তর হাতছানি কেউ এড়াতে পারে না। একটা সময় গরিব বাঙালির পাতে প্রায় রোজই থাকত এই সস্তার আলু পোস্ত। স্বাদে চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় বড়লোক ঘরেও এর আনাগোনা ছিল নিত্যদিন। এখন সেই সস্তার পোস্ত কেজি প্রতি হাজার ছুঁইছুঁই। তাই মধ্যবিত্ত বাঙালি আর রোজ পোস্ত খেতে পারে না। তবে খাওয়া ছাড়েও না। তবে জানেন কি এই স্বর্গীয় সুখের খোঁজ বাঙালি ঘরে এই সেদিন পর্যন্ত ছিল না? আলু, ঝিঙে পোস্তর স্বাদ বাঙালি পেয়েছে মাত্র আড়াইশো বছর আগে? তাহলে গোড়া থেকে বলি।
মোঘলাই খসখস
মোঘল আমলে আমাদের দেশে পোস্তর প্রচলন ছিল। রান্নার ঘর গ্রেভি তৈরির কাজে পোস্ত বাটা ব্যবহার করা হত। যাঁরা নানা ধরনের রান্নাবান্না করেন তাঁরা ভালো মতোই জানেন যে স্বাদ এবং ঘনত্বের জন্য মোগলাই খাবারে পোস্ত বাটা ব্যবহার করা হয়। সে সময় মূলত বিদেশ থেকেই পোস্ত আমদানি করা হত। পরবর্তী সময়ে অভিজাত সম্প্রদায়ের জন্যেই এদেশে আফিম চাষ শুরু হয়। আফিমের বীজকে পোস্ত এবং ফুলকে নেশার কাজে ব্যবহার হতে শুরু হল। তবে সে খুবই সামান্য। গোটা দেশের মানুষ, এসব নাগালে পেতেন না।
আয়ুর্বেদে পোস্ত
অবশ্য মোগল আমলে পোস্তকে খাবারের স্বাদ বাড়ানোর কাজে ব্যবহার করা হলেও প্রাচীন ভারতীয় আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে পোস্তকে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হত। ধন্বন্তরী নিঘন্তু পুঁথিতে পোস্তর ব্যবহাররে উল্লেখ আছে।
চিনের ষড়যন্ত্র
সে যাই হোক, পোস্তর ব্যবহার এদেশে বৃদ্ধি পায় ব্রিটিশ আমলে। সে আমলেও চিনারা নিজেদের অভিনব বুদ্ধি এবং প্রয়োগের ফলে গোটা বিশ্বকে কাঁচকলা দেখাতো। ব্রিটিশদেরও দেখিয়ে দিল। চিনের ফলতে শুরু করল টন টন আফিম। যার নেশায় বুঁদ হতে শুরু করল গোটা বিশ্ব। বাদ গেল না ব্রিটিশ সৈন্যরাও। ভারতে চোরাপথে আফিমের চালান আসত। হিসেব করে দেখা যায় লাখ লাখ টাকার আফিম চোরাপথে এদেশে আসছে। ইংরেজরা বণিকের জাত। ব্যবসার বুদ্ধি তাঁদের দারুণ। তারা দেখলে চিনাদের কাছ থেকে আফিম এদেশে আসর চেয়ে যদি নিজেরাই আফিম চাষ শুরু করে তাহলে তো লাভ অনেক বেশি হবে।
লোভের ফসল
যেমন ভাবা তেমন কাজ। মোটামুটি ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের পর থেকেই চিনদেশ থেকে আফিম আসার বিষয়টি ইংরেজদের নজরে আসে। আসলে নবাবের রাজত্বে আফিমের চোরাকারবার চলত। এমনকি নবাবের ঘরের নামজাদা বেগমরা বেনামে লক্ষ লক্ষ টাকার আফিমের ব্যবসা চালাতেন। পলাশী যুক্তে নবাব সিরজা-উদ-দৌল্লাকে পরাজিত করার পর এসব ইংরেজদের গোচরে আসে। শুরু হয় গবেষণা এবং তার সঙ্গে বাংলা-বিহার-ওড়িশাতে ব্যাপকহারে আফিম চাষের নির্দেশ দেয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।
সেরা আবিষ্কার
বাঙালি কৃষকের উপায় নেই। জমিদার পাশে থাকে না। ইংরেজ সেনাদের চাবুক পেটা আর নানা ধরনের অত্যাচারের চাপে পড়ে আফিম চাষ করতে বাধ্য হন তাঁরা। বিঘের পর বিঘে জমি আফিম চাষ হচ্ছে। ফুল তো না হয় নেশার কাজে গেল। কিন্তু বীজ, বীজের কী হবে? এই দানা দানা সাদা বালির মতো জিনিসগুলো নিয়ে হবেটা কী?
শোনা যায় খিদের জ্বালায় কৃষক ঘরের গৃহিনীরা এটা ওটা দিয়ে কোনোরকমে সংসারের পেট চালাতেন। এরকমই এক কৃষক গৃহিনী আর কিছু না পেয়ে ওই আফিমের দানা বেটে সর্ষে তেলে মেখে পান্তাভাত দিয়ে পরিবারের সদস্যদের খেতে দিলেন। সঙ্গে আলু সিদ্ধ। খিদের মুখে অমৃত। তিনিই আবার একদিন পোস্তদানার সঙ্গে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে গিয়ে ঝিঙে দিয়ে তৈরি করে ফেললেন চচ্চরি। আর ওই রমণীর হাত দিয়ে সে সময় যে জিনিসটি আবিষ্কার হয়েছিল তা বাঙালির জীবনে আগুন আবিষ্কারের মতোই গুরুত্বপূর্ণ বোধহয়। ধীরে ধীরে চারদিকে এই নতুন পদের নাম ছড়িয়ে যায়। খেতের আফিম উঠে যাওয়ায় তখন সকলের ঘর পোস্ত দানায় ভরপুর। ব্যস আর যাবে কোথায় আলু, ঝিঙে, বেগুন দিয়ে চলল পোস্ত বাটার নানা পদ ভোজন। সঙ্গে সর্ষের তেল সহযোগে কাঁচা বাটাও চলল মজাসে। ধীরে ধীরে পোস্তর বড়ার আবিষ্কারও হয়ে যায়। মোগলদের রসুইখানার খসখস পরিণত হল বাঙালি হেঁশেলের নিত্যদিনের খাবার। গ্রীষ্ম হোক বা বর্ষা, শীত হোক বা শরৎ নিরামিশ হোক বা আমিষ পোস্ত বাটা যুগযুগ জিও।
Lifestyle News in Bengali, লাইফস্টাইল খবর, Health Tips, Fashion Trends and Tips in Bangla
2021-06-21 16:03:45
Source link
Leave a Reply