সমস্যা: সুদীর্ঘ ৩২ বছর উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করার পর বর্তমানে অবসর জীবন যাপন করছি। এখন আমার সামনে অফুরন্ত সময়। সময় কাটানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। সব সময় বাড়িতে বসে থাকি। কোনো কাজকর্ম না থাকায় মনমেজাজ সব সময় খিটখিটে হয়ে থাকে। স্ত্রীর সঙ্গে সামান্য ব্যাপারেই ঝগড়াঝাটি লেগে যায়। বাইরের জগতের সঙ্গে সম্পর্ক আস্তে আস্তে গুটিয়ে আসছে। আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুযায়ী কোনো কাজ খোঁজার চেষ্টা করেও তা পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। একজন অবসরপ্রাপ্ত লোক হিসেবে পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে যে ধরনের সহযোগিতা পাওয়ার কথা, তা পাওয়া যাচ্ছে না। বর্তমানে জীবন, জগত্ ও সংসার আমার কাছে অর্থহীন মনে হয়।
উদাস, শিববাটি, বগুড়া
পরামর্শ: আপনার সুন্দর চিঠির জন্য অনেক ধন্যবাদ। মানুষের জীবনের এ সময়টিতে হতাশা আর বিষণ্নতা বোধ হওয়া খুব স্বাভাবিক। আর সে কারণেই আমরা যদি অনেক আগে থেকে এ সময়টির জন্য কিছু মানসিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করি, তাহলে খুব ভালো হয়। অবসর নেওয়ার পর কিছু সমাজসেবামূলক কাজ করতে পারলে সময়ও ভালো কাটে আর একই সঙ্গে অনেক সন্তুষ্টি আসে। যেমন আমরা নিজের প্রতিবেশী শিশুদের নিয়ে ক্লাব তৈরি করতে পারি, যেখানে তারা পড়ালেখার বাইরে যে বিষয়গুলো শেখার আছে, সেগুলো চর্চা করতে পারে। এ ছাড়া সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের উপকার হয়, এমন কিছু কাজের কথাও ভাবা যেতে পারে। যেহেতু, এ বয়সে অনেক অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞান সঞ্চয় করি, তা আগামী দিনের নাগরিকদের সঙ্গে শেয়ার করলে তাদের অবশ্যই অনেক উপকার হবে এবং সেই সঙ্গে আমরাও তাদের কাছ থেকে আধুনিক প্রযুক্তি সম্পর্কে জ্ঞান নিতে পারি। নিজের জীবনকে সব পর্যায়ে অর্থপূর্ণ করে তোলার দায়িত্ব কিন্তু আমাদের প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর থেকেই নিতে হবে। কারণ, আশপাশের মানুষগুলো তো সব সময় আমাদের চাহিদা বুঝে চলবে না। বর্তমান যুগের জীবনযাত্রায় এত জটিলতা তৈরি হয়েছে যে আপন মানুষদেরও এতটা সময় থাকে না নিজেদের দায়িত্বগুলো পালন করে অন্যদের দিকে মনোযোগ দেওয়ার। এ ছাড়া প্রথম জীবনে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালো বন্ধুত্ব তৈরি হলে অবসর নেওয়ার পর তাদের খুব ভালো সময় কাটে। আপনাদের দুজনের মধ্যে প্রথম থেকে কতটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে, সেটা ভেবে দেখতে পারেন। আমি আপনাকে অনুরোধ করব, কিছুটা সুস্থ বিনোদন এবং অর্থপূর্ণ কার্যক্রমের ভেতরে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে। আমাদের দেশে আসলে চিকিত্সা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাসহ বয়স্ক লোকদের দল বা সংঘ তৈরি করা খুব প্রয়োজন। আপনার হয়তো মনে হচ্ছে, অন্যেরা অবহেলা করছে। কিন্তু আপনি অন্তত নিজেকে অবহেলা করবেন না। নিজের প্রতি পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা অক্ষুণ্ন রেখে সমাজের জন্য যতটুকু করা সম্ভব তা করে, বাকি জীবনটুকু কাটিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করবেন কি?
সমস্যা: আমার মা-বাবা সরকারি কর্মকর্তা। ছোটবেলায় মা প্রায়ই প্রশিক্ষণের জন্য বিভিন্ন জায়গায় যেতেন। তখন আমাকে খালার বাসায় রেখে যেতেন। খালু একবার আমার সঙ্গে ভীষণ বাজে আচরণ করেছিলেন। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়তাম আমি। কাউকে কিছু বলতে পারিনি, কিছু বুঝিওনি। ভালো বোঝার অবস্থা হলো, মাকে বললাম। বাবা বিশ্বাস করেননি। কারণ, খালু ছিলেন শিক্ষক। ভীষণ কেঁদেছিলাম সেদিন। আমার গানের স্যারও সেরকম ছিলেন (খালুর মতো)। ছোটবেলায় কিছু বুঝতাম না। কিন্তু এখন সব বুঝি। সুন্দর হওয়ার কারণে আর মা-বাবার বিশ্বাসের কারণে আমার দূরসম্পর্কের বা কাছের আত্মীয়স্বজন ছোটবেলায় আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করতে চাইত এবং প্রায় সবাই ছিল বিবাহিত। এখন আমি প্রতিবাদী হয়েছি, বড় হয়েছি। কিন্তু কোনো ছেলেকেই সহ্য করতে পারি না। সবাই মনে হয়, ভেতরে ভেতরে এমন নিকৃষ্ট, জঘন্য। আজ পর্যন্ত আমার কোনো ছেলে বন্ধু নেই। একজনকে ভালোবেসে ছিলাম মনপ্রাণ দিয়ে, সেও খালুর মতো ছিল। আমি সরে এসেছি কিন্তু তাকে ভুলতে পারিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
পরামর্শ: তোমার জীবনের ঘটনাগুলো অত্যন্ত বেদনাদায়ক এবং অনাকাঙ্ক্ষিত। বেশির ভাগ মেয়েরই শৈশবের কোনো না কোনো সময় কমবেশি এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার হতে হয়। আর এই ঘটনার মূল ব্যক্তিটির সঙ্গে যখন আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকে, তখন যন্ত্রণার পরিমাণ হাজার গুণ বেড়ে যায়। কারণ, এসব মানুষকে বারবার দেখতে হয়। সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার, তোমার কোনো দোষ না থাকা সত্ত্বেও তোমাকেই এই বিরক্তিকর ও ঘৃণার অনুভূতিটি নিয়ে জীবনে চলতে হচ্ছে। যারা অপরাধী, তারা কিন্তু প্রায় কোনো অনুশোচনা ছাড়াই সমাজে বাস করছে। আমার কাছে এ পর্যন্ত অনেকেই থেরাপি নিতে এসেছে, যাদের জীবনের ঘটনার সঙ্গে তোমার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার সাদৃশ্য আছে। মা-বাবাকে তাদের শিশুসন্তানকে এ ধরনের ঘটনা থেকে রক্ষা করার ব্যাপারে যতটা সম্ভব সতর্ক থাকতে হবে। ছেলেশিশুরাও কিন্তু এ থেকে রক্ষা পায় না এবং বড় হওযার পর তাদের জীবনেও নানা জটিলতা দেখা দেয়। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, শিশুকালের এ অভিজ্ঞতাগুলো আমাদের পরবর্তী জীবনে খুব বেশি প্রভাব ফেলে আর সে কারণেই অপরাধীদের অন্যায় যে কতটা গুরুতর, তা সহজেই অনুমেয়। বুঝতে পেরেছি, প্রেমিকের ওপর তুমি আস্থা হারিয়েছ এবং সেটা তোমার দুঃখ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে একটা কথা কি জানো, পৃথিবীর সব পুরুষই যদি এমন হতো, তাহলে সব মেয়ে আরও অনেক বেশি কষ্টের ভেতরে থাকত। চলো, আমরা বিশ্বাস করি, সমাজে অনেক সচ্চরিত্রের, সত্ পুরুষেরাও রয়েছেন, যাঁরা নিশ্চয়ই অনেক শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার রাখেন। এ রকম কিছু মানুষের সংস্পর্শে তুমি ভবিষ্যতে আসবে, এ আশা বুকে নিয়ে পথচলা যায় কি? আপাতত তুমি তোমার সম্ভাবনাময় জীবনটাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হও। তুমি যখন যোগ্য হবে, তখন সমাজের এই অন্যায়গুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সংকল্প নাও।
অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম
কাউন্সেলিং সাইকোলজি
মনোবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ২৬, ২০০৯
Leave a Reply